স্বাধীনতার জন্ম
মুহম্মদ নূরুল হুদা
মুহম্মদ নূরুল হুদা। ১৭ মার্চ ২০১৮ ৮:৩২ অপরাহ্ণ
কোটি কোটি বছর ধরে বস্তু ও অবস্তুর গর্ভজাত
মহাকর্ষের মহাসাংঘর্ষিক মহামিলন থেকে সহজাত
জন্ম-সৌভাগ্য যে জাতি বাঙালির, তারই দিগন্তবিস্তৃত
পলিবাংলার প্রথম মুক্তপলিপুত্র তুমি,
হে আমার তামাটে পিতা।
তোমার শরীরে-মনে মিশে আছে
জগতের সব ধর্ম-কর্ম, সব গোত্রবর্ণ,
নন্দনবন্ধনের সব স্বর্ণাস্বর্ণ।
তুমি এই বঙ্গভূমি থেকে বিজয়সিংহের দিগন্তবিস্তারী সতৃষ্ণ সাঁতার,
রাখালরাজ গোপালের মাঠে মাঠে সর্বশস্যের ধুধু সোনালি খামার,
চর্যার পদকর্তা ভুসুকুর চিত্তে বংপ্রজাতির প্রথম প্রমুক্ত পঙ্ক্তির ক্ষরণ,
মাতৃবাণী মাতৃউক্তি বাঙ্গালার সপক্ষে হাকিমের জাতিস্মর উচ্চারণ,
মধ্যযুগে স্বঘোষিত স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহের অনার্য ভাষা-তূর্য,
বিদ্যাপতি-আলাওল-চণ্ডীদাশের স্পর্শ-ও-বর্ণ-নিরপেক্ষ নন্দনসূর্য,
জাতিত্যাগী বিশ্বভিখারী মাইকেলের শ্রীমধুসূদন হয়ে নিশর্ত ঘরে ফেরা, Ñ
তুমি জগতের তাবৎ জাতিতত্ত্বের সত্যাসত্য চুলচেরা;
তুমি গগন হরকরার তৃণাভিসারী লোকচিত্তে জল-ছলোচ্ছল মনোবাংলা,
গুরুকবি রবীন্দ্রনাথের বৈদিক বুকে বাউলের লালনোজ্জ্বল সোনার বাংলা,
ভৃগু-বিদ্রোহী নজরুলের বুকে-মুখে বেনিয়া-তাড়ানিয়া ব্রহ্মাস্ত্র জয়-বাংলা,
শহিদ-গাজী ক্ষুধিরাম-বরকত- সূর্যসেন-তিতুমীরসহ সব ভাষাযোদ্ধা আর
তাবৎ কালের তাবৎ মুক্তিযোদ্ধার বঁাঁশের কেল্লার সাহসের অধিকারÑ
তুমি সার্বভৌম বাঙালী তর্জনী, তার আকাশ-শাসানো ব্যাঘ্রের চূড়ান্ত হুঙ্কার।
তুমি মধুমতি, ধানসিঁড়ি, পদ্মা-মেঘনা-কর্ণফুলী-ব্রহ্মপুত্র আর হাজার নদীর
জলবাংলা, তার উত্তাল তরঙ্গভঙ্গ। তুমি অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গের মুক্তিযুদ্ধ সর্বজয়ীর;
তার স্বাধীনতা, তার যুক্তিযুদ্ধ। তুমি বঙ্গবন্ধু, তুমি মুক্তবন্ধু, তুমি এই বাংলার
আগত-অনাগত তাবৎ বঙ্গসন্তানের চিরকালের স্বাধীনতার আরাধ্য টঙ্কার।
না, তুমি মানোনি কারও অধীনতা,
না, আমি মানিনি কারও অধীনতা,
না, বাঙালী মানে না কারও অধীনতা।
আমার স্বাধীনতা মানে তোমার স্বাধীনতা,
তোমার স্বাধীনতা মানে আমার স্বাধীনতা;
না, আমার স্বাধীনতা মানে
তোমাকে আমার পরাধীন করা নয়;
জয় হোক, জয়
জাতিজ্ঞাতি নির্বিশেষে
দেশে দেশে কালে কালে
মুক্ত ব্যক্তিমানুষের জয়।
জন্ম হোক, সার্বভৌম স্বাধীনতার নৈয়ায়িক জন্ম,
স্বাধীনতা হোক নৈয়ায়িক ব্যক্তিসত্তার ব্রহ্ম-জন্ম।
১৭.০৩.২০১৮
জাগ্রত চেতনা তুমি স্বাধীনতা
হাসান হাফিজ
অনিঃশেষ লড়াইয়ের অন্য এক জ্বলজ্বলে নাম।
শুরু আছে, শেষ নাই, যবনিকা বলে কিচ্ছু নাই।
রক্তসিঁড়ি পার হওয়া, ক্রমাগত সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠা।
তিতিক্ষা ও ত্যাগ শুধু। অশ্রুফোঁটা বিসর্জনÑ
সম্ভ্রমের মূল্যে তাকে পেতে হয়। কোনো ছাড় নাই।
সে এক আশ্চর্য তেজ, অহমিকা, শক্তি উদ্ভাসন।
ধুঁকতে ধুঁকতে পুড়তে পুড়তে সবই তছনছ।
ভাঙ্গন ধ্বংস ও ক্ষয় বিপর্যয় অনন্ত প্রলয়।
সে দীর্ঘ প্রক্রিয়া। শুরু আছে। আবর্ত মন্থনও আছে।
আপাত-বিজয়ে নেই সন্তুষ্টির লেশমাত্র অবকাশ।
এই যুদ্ধ চলমান। এই সোনা আগুনেই পুড়ে খাঁটি হয়।
রক্তঋণে প্রতিরোধ, সশস্ত্র লড়াই, জাগ্রত চেতনা তুমি।
স্বাধীনতা অনশ্বর। দুরন্ত অস্থির এক অতৃপ্ত তিয়াসা।
অন্য গল্পের ভূমিকা
সোহরাব পাশা
আকুলতায় জড়িয়ে রাখে মায়াটান নিভৃতির
বিচ্ছিন্ন পথের দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনী
দূরের কার্নিসে তার বিহবল বিভূতি
সমর্পিত
লাবণ্যের উন্মাদ আগুনে পোড়ে স্নায়ু
দুপুরের খোলা চুলে ফুরোয় না
নীল চোখের গুঞ্জন
শীতের বাতাসে রোদ ভাঁজ করা কী আনন্দ ওড়ে
জানে না অজ্ঞাত বাস দূরের যুবতী
জড়োসড়ো বুকের কাঁপন খোঁজে উষ্ণ প্ররোচনা
জাগে স্বরচিত লজ্জার বাঁধন ছেঁড়া
গান,
শুশ্রƒষাকাতর নির্বোধ বিশ্বাস তাকে
নতজানু করে
নগ্ন করে ছন্দহীন এই অবিশ্বাসের দশকে
মায়ার কুহক
স্বপ্নের ভেতর ডানা ঝাপটায় মেঘের বাদুড়
দূরে বাজে আহত সুরের ক্লান্ত
বিষণœ পিয়ানো,
তীব্র কুয়াশায় ভিজে যায় রাত্রি ছেঁড়া
হেমন্তের ঝরাপাতা
অন্য গল্পের ভূমিকা লেখে মায়াপথ
দেশজননীর অমূল্য কাঁকন
মারুফ রায়হান
বিশুষ্ক মাটির ফুল এ-বসন্তে আকাশের তারা
কবিরা বোঝেন বুঝি দূর নক্ষত্রের মন! তবু
কভু নয় লড়াকু নারীর সান্দ্র হৃদয়স্পন্দন
হে বীরপ্রতীক, মার্চেÑ চারু-চৈত্রে- আপনার যাওয়া
যুগপৎ ভালোবাসা-উপেক্ষার আপনি প্রতীক
যদিও অন্তিমে হাতে আমাদের গোলাপ, বিউগল
একাত্তরের নির্ভীক গুপ্তচর, শত্রুর বাঙ্কারে
উত্তপ্ত রডের দগ্ধ গূঢ় ক্ষত নিয়ে হে স্বাধীনতা
পুনরায় অগ্নিফুল হয়ে ফোটেন মিত্রের ক্যাম্পে
হাতে তুলে নেন শত্রু নিধনের ঋজু রাইফেল
সশ্রদ্ধ সালাম নিন বাংলার সামান্য কবির
সুদীর্ঘ পীড়ন সয়ে আপনি গর্বিত সর্বংসহা
আরো একবার আমাদের মনে অপরাধবোধ
এ সমাজ এখনো পারেনি দিতে যথার্থ সম্মান
‘খাসিয়া মুক্তি বেঠি’ বলে বুক চাপড়ায় আজ
সুনামগঞ্জের সুর, পুঞ্জি-বালা, আলীর হাওড়
দেশজননীর দীপ্ত হাতে আপনি, কাঁকন বিবি,
স্বপ্নজাগানিয়া এক অসামান্য অমূল্য কাঁকন
২৫ মার্চ ২০১৮
প্রকল্পকাব্য
মিজানুর রহমান বেলাল
এই শহরে কত কাল খয়েরি ফড়িং উড়তে দেখিনি-
বিলুপ্ত প্রকল্পে কিছু পাখাদৃশ্য উড়তে দেখি হাওয়ার ভাঁজে
চারিদিক তুমুল প্রার্থনাÑপৃথিবীতে যতো শান্ত প্রাণীদের বংশ
নষ্ট আঁধারে কীভাবে ধ্বংস করা যায়;
ভূতুড়ে পরমাণুশক্তির ক্যাকটাসদৃষ্টি সব বিবর্ণ করে দেয়।
সবুজ পৃথিবীতে সব প্রাণী সমগোত্রীয়
এই ভেবে খয়েরি ফড়িং অনায়াসে উড়তো আকাশের রেখাহীন পথে
যে পৃথিবীতে জাত নিয়ে মানুষের গ্রীবায় ঝরে দুরন্ত আগুন
সেই পৃথিবীতে শান্তিকামী প্রাণীদের বিলুপ্তি প্রথাগত...
বিলুপ্ত খয়েরি ফড়িং হয়তো আবার আসবে অশুভ আত্মা হয়ে
নষ্ট আঁধারে ধূলিমিশ্রিত প্রজনন প্রকল্পে।
মানুষ এগিয়ে যাবে
দুলাল সরকার
স্বাধীনতা দিবসে তুমি কি শাড়ি পরবে বলে ভেবেছ?
লাল, নীল, বেগুনি, জলপাড়ে-এর সাথে নতুন
কি ভাবনা ভেবেছ যুদ্ধ শিশুবিষয়ক মানুষের
নিহিত কল্যাণবোধের সাথে যুক্ত করে শ্রেণীহীনতার কথা
মুক্তবুদ্ধির যুদ্ধের চর্চায় মানুষ এগিয়ে যাবে বহুদূর;
নীল শাড়ির অন্তরালে যে দেহটি কঙ্কাল আশ্রিত
একটু একট ুকরে ভাব কোথায় কোথায় এর বন্যসহোদর
কিংবা কোন চারুময় অভিধান থেকে উঠে এসে কালের কলস
যুক্ত হয়ে মুহূর্তের খ- খ- বছরের দীর্ঘজীবন
অপরিবর্তনই থেকে যাবে ভূমিজ জীবন, বস্তির উপমা?
অথবা রাতের পান্থপথে কোন্ দিকে যাবে
যদি বুঝতেই না পার তবে জানতে চাইবে না...
এই গ্রহণ ক্ষেত্রের দেশে কতটা আত্মতুষ্ট তুমি স্বাধীনতা পেয়ে?
নাকি অদৃশ্য বেদনা আছে কোন সামাজিক অসঙ্গতি
ধর্মীয় সংহার সম্পর্কে ব্যর্থ হয়েও তুমি রাখছ ভূমিকা?
আরব সাগরের নীল জলে
আলমগীর রেজা চৌধুরী
আরব সাগরের নীল জলে কার মুখ ভেসে ওঠে?
ছলকে উঠে পরবাসী নাগরের হৃৎপি-,
শিরদাঁড়ায় অলৌকিক কাঁপন,রক্ত কামতৃষ্ণাতুর,
যুবকের মন জুড়ে বিষণœ আশেকী শুষ্ক আকাশ।
দূরে আরব ললনাদের অনিন্দ্য শরীর
সূর্য¯œানে মেলে দিয়েছে বিকেলের মোহময় ছায়ায়
সমুদ্র তটরেখায় নারঙ্গী বনে অপলক-
দোলনা চেয়ারে দুলতে দুলতে ওর অতৃপ্ত
নারী বাসনায় পরবাসী যুবক তাকাতে চায় না।
ও প্রাচীন আরব্য রজনীর রাজপথে হেঁটে হেঁটে
যার দেখা পায়, সে ঝরোকার নিচে
লুকানো বদন নয়,
বার বার চমকে ওঠা আতঙ্কিত মরু ললনা।
নাঙ্গা তরবারি হাতে সেনাপতি মশরুর’র
আজ্ঞাবহ ক্রুব্ধ, নিঃস্ব নারী।
যে কিনা জবেদা নহরে ধুয়ে ফেলে
রক্ত কামলিপ্সা ক্ষত চিহ্ন?
যুবক এসব ভাবতে চায় না।
প্রাক-সন্ধ্যায় নীল জলে কার মুখ?
সী-বিচ জুড়ে বিচিত্র পদচিহ্ন, জলে অস্তমিত
সূর্য আর মীনদের শিশুসুলভ লুকোচুরি।
আরব সাগরের নীল জলে পরবাসী মোবারক
শাহারজাদী’র মুখচ্ছবি খুঁজতে চায় না।
ওর অক্ষিযুগল জুড়ে যে ল্যান্ডস্কেপ
তার অবয়বে প্রিয় নারী বানু’র পোর্ট্রেট।
স্বাধীনতার সূর্য ওঠে
মুহাম্মদ সামাদ
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ
শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠে
গর্জে ওঠে বাংলাদেশ
বীর বাঙালি শপথ করে
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে।
পঁচিশে মার্চে কালরাতে
ঝাঁকে ঝাঁকে নামে কনভয়
ঘুমন্ত মানুষ কেঁপে ওঠে
ভয়, চোখে মুখে শুধু ভয়!
যেনো খুনের নেশায়
যমদূতের হিংস্্র কড়া নাড়া।
নবজাতকের আর্তনাদে
হায়! স্তব্ধ হয়ে যায় পাড়া।
লেলিহান শিখায় শহর বস্তি
ছাত্রাবাস যায় পুড়ে।
এ কেমন ভয় নামে ভয়!?
আমার সবুজ দেশে
হলোকাস্ট বা ভিয়েতনাম আজ
গণহত্যার উপমা হয়!
পাখির পাখায় হাওয়ায় হাওয়ায়
গাঁয়ে গঞ্জে মাটিতে পাহাড়ে
পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে
উথাল ঢেউয়ে ছাব্বিশে মার্চ
শেখ মুজিবের ডাক আসে:
মুক্তি পাগল ভাইরে আমার
মুক্তি পাগল বোনরে আমার
এক হও জোট বাঁধো
কণ্ঠে তোলো জয় বাংলা
হাতে নাও যার যা আছেÑ
অস্ত্র ধরো অস্ত্র ধরো অস্ত্র ধরো..
বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
সেই বসন্তে ঝরাপাতায়
রোদে জলে দিনে রাতে
অস্ত্র কাঁধে অস্ত্র হাতে
মুক্তিযুদ্ধ ছুুটে আসে।
পথে ঘাটে বন বাদাড়ে
নদীর বুকে ঝড় বাদলে
বাংলা মায়ের দামাল ছেলে
বাংলা মায়ের রুদ্র মেয়ে
জীবন দিয়ে সম্ভ্রম দিয়ে
গুলি বন্দুক গ্রেনেড ছুড়ে
যুদ্ধ করে... যুদ্ধ করে...
বীর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।
যুদ্ধ শেষে মুক্ত দেশে
রক্তমাখা পুব আকাশে
আলোয় আলোয় স্বপ্ন ফোটে
ঘাসে গাছে ফুলে ফুলে
স্বাধীনতার সূর্য ওঠে
স্বাধীনতার সূর্য ওঠে।।
১৭ মার্চ ২০১৭-২৩ মার্চ ২০১৮
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়