ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাল্যবিবাহ ঠেকানোর পদক্ষেপ

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাল্যবিবাহ ঠেকানোর পদক্ষেপ

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ প্রবৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় নিয়মিতই এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও হরেক রকম সামাজিক অভিশাপের আবর্তে পড়ে জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ বিপাকেও রয়েছে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে অসহায় এবং নির্বিত্ত অংশই সব সময় অসাম্য-বৈষম্যের শিকার হয়। আর দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া অংশ হিসেবে নারীদের এ দায়ভাগ সব থেকে বেশি নিতে হয়। সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিয়ে রদের যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এক বিংশ শতাব্দীর ২য় দশকে এসেও সেই লড়াই আজ অবধি চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ১৯২৯ সালে বাল্যবিয়ের বয়স সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ এবং মেয়েদের বেলায় ১৮। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় এই আইনী বিধানকে উপেক্ষা করে আরও কম বয়সে ছেলেমেয়েরা বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসে। এক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থা আরও শোচনীয়। সামাজিক জরিপে উঠে আসে প্রায় ৫২ ভাগ বালিকাদের বিয়ে ১৮ এর আগেই হয়ে যায় আইনগত বিধিকে তোয়াক্কা না করে। কারণ এই আইন ভঙ্গের জন্য কাউকে কোন শাস্তি পেতে হয় না। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই ধরনের অপরাধের মাত্রাকে এত বেশি উস্কায় যা পুরো সমাজব্যবস্থাকে বিপন্ন অবস্থায় ঠেলে দেয়। কারণ বাল্যবিয়ের সঙ্গে কোন মেয়ের গড়ে ওঠা, শিক্ষালাভ থেকে শুরু করে স্বাবলম্বী হওয়ার পর্যায় পর্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মানেই সচেতন নাগরিকের সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধুমাত্র সংসার জীবন পালন করা, যা দেশে সামগ্রিক উন্নয়নের গতিধারাকেও বিঘিœত করে। সুতরাং এই সামাজিক অপসংস্কারকে প্রতিরোধ করতে সরকার কয়েকটি প্রশাসনিক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘গবর্নেন্স ইনোভেশান ইউনিট’ ১০টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করেছে। ইউনিটের মহাপরিচালক আবদুল হালিমের সভাপতিত্বে বাল্যবিয়ে নিরোধ সংক্রান্ত নির্দেশনার অগ্রগতির ব্যাপারে এক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দেয়া ৫৭টি নির্দেশনার সর্বশেষ অবস্থা উপস্থাপন করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে নির্দেশনার অগ্রগতি সম্পর্কে সভাকে অবহিত করেন। নির্দেশনায় বলা হয়, বাল্যবিয়ের সঙ্গে যারা জড়িত থাকবে সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে বিয়ে পড়ানোর কাজীকেও অব্যাহতি দেয়া যাবে না। বিশেষ করে মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষক, মৌলবী, ঠাকুর, পুরোহিত, স্থানীয় পঞ্চায়েত, বিয়ের সাক্ষী সবার সম্মিলিত ভূমিকায় বিয়ে নামক সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মটি সম্পাদিত হয়। আর এই বাল্যবিয়ে ঠেকানোর উপায়ও থাকে এসব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাতে। সুতরাং তাদের আপত্তিতে এই ধরনের অকাল-বিয়ে কোনমতেই হতে পারবে না। বাল্যবিয়ের ক্ষতির দিকগুলো নির্দেশ করে ইতোমধ্যে ২০ হাজার ইমামকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিয়ে পড়ানোর কাজীদেরও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। যাতে তারা বর-কনের জন্মনিবন্ধন দেখে তাদের বয়স চিহ্নিত করে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে পারেন। কাবিননামায় বর-কনের ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সরকার প্রদত্ত এসব নির্দেশনায়। সব মন্ত্রণালয় এক সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করলে ‘বাল্যবিয়ে’ নামক সামাজিক ব্যাধিকে নির্মূল করা আসলে কোন ব্যাপারই নয়। এই নির্দেশনামাগুলো মূলত আইন ও বিচার বিভাগ, সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা অধিদফতর, ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদফতর সমীপে পাঠানো হয়েছে। স্ব স্ব মন্ত্রণালয় এই নির্দেশনামার ভিত্তিতে তাদের করণীয় দায়িত্ব পালন করতে সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন কার্যক্রমের অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এসব কর্মসূচীর আওতায় শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধ ও বাল্যবিয়েকে ঠেকাতে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। বিধি সম্মত উপায়ে বিয়ে সম্পাদনের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি প্রয়োগ করতেও বৃহত্তর জেলাগুলোতে কনসালটেন্টের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণের আয়োজন করে বাল্যবিয়েকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সহায়তা করবেন। এছাড়াও শিক্ষা গ্রহণের মাঝপথে কোন শিশু শিক্ষার্থীর জীবনে যেন বাল্যবিয়ের প্রকোপ ছড়াতে না পারে, সে ব্যাপারে শিক্ষকদেরও সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরী।
×