
সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক স্বর্ণ দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। এ সেতু নির্মাণে দুর্নীতির কোনই সুযোগ ছিল না। বরং এই সেতু নির্মাণের পর পুরো দেশের মানুষের মধ্যে অসম্ভব আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে যে, আমরাও পারি। মানুষের ভেতরে যে শক্তি উৎসারিত হয়েছে, সেই শক্তি পদ দেখাবে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে। ইনশাআল্লাহ অপ্রতিরোধ্য গতিতে দেশ এগিয়ে যাবে, আমাদের এই অগ্রযাত্রা আর কেউ পিছিয়ে দিতে পারবে না। এই সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশে আমদানি-রফতানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
টার্গেটকৃত সময়ের অনেক আগেই পদ্মা সেতুর খরচের টাকা উঠে আসবে এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৫ বছরের মধ্যে খরচের টাকা উঠে আসার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, অনেক আগেই আমরা এই সেতুর টাকা তুলে ফেলতে পারব। কারণ এই সেতুর যোগাযোগটা আরও বিস্তৃত হবে। কাজেই ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে আমাদের টাকা উঠে আসবে। এই পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন উচ্চতায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। এই সেতু ২১ জেলার কম বেশি তিন কোটি মানুষ আত্মসামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নতি হবে। দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ১ দশমিক ৩ শতংশ। বর্তমানে অর্থনৈতিক অবস্থার যে উন্নতি করেছি তাতে আমরা আরও বেশি লাভবান হব।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার রাতে বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এই পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ না, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যাতে আরও উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে সেই সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা আরও বলেন, ফিজিবিলিটিস্ট্যাডি অনুযায়ী টোল আদায়ের মাধ্যমে ২৫ থেকে ২৬ বছরে খরচ উঠে আসার পূর্বাভাস ছিল। নিজস্ব অর্থায়নের এই খরচের টাকা সেতু কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। ১ শতাংশ সুদসহ ২৫ বছরে সরকারকে ফেরত দেবে। সেই চুক্তি করে সেতু কর্তৃপক্ষ ঋণ নিয়েছে। এই সেতু হয়েছে আমাদের নিজের টাকায়। বাংলাদেশের টাকায়। আমি মনে করি অনেক আগেই আমরা এই সেতুর টাকা তুলে ফেলতে পারব। কারণ এই সেতুর যোগাযোগটা আরও বিস্তৃত হবে। কাজেই ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে আমাদের টাকা উঠে আসবে।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিরোধিতাকারী ও সমালোচকদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এসব সমালোচককারীরা দেশের মানুষের অসীম শক্তি আর তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। না হলে কিভাবে তারা পদ্মা সেতু নির্মাণে বাধা দেবে কেন? এরা সব সময় জাতিকে অবমূল্যায়ন ও হেয় প্রতিপন্ন করে। অন্যের কাছে হাত পেতে চলব এই মানসিকতা নিয়েই তারা চলে। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী জাতি, আমরা মাথানত করে চলি না, চলব না। কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না।
সংসদ নেতা বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে এখানে কতগুলো প্রশ্ন এসেছে, বিরোধী দলের সদস্যরা অনেক কথাই বলেছেন। প্রথম প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ হাজার কোটি ধরা হলেও পরবর্তীতে ৩০ হাজার কোটি লাগার কার্যকরণ বিশ্লেষণ তথ্য-প্রমাণসহ সংসদে উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই সেতু নির্মাণে তাঁর সরকারের বহুদিনের প্রচেষ্টা ছিল, যার ভিত্তিপ্রস্তরও তিনি ২০০১ সালে স্থাপন করে যান। যদিও পরবর্তী বিএনপি সরকার সেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। আর ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি ব্যয় প্রাক্কলন করে (১০ হাজার কোটি টাকা) যার কোন বাস্তব ভিত্তি যেমন ছিল না, তেমনি এরপর বহু যোজন-বিয়োজন হয় প্রকল্পে।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্রচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় এবং সরকারের দায়িত্ব নেয়ার ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নক্সা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল এইকম’কে নিয়োগ দেয়। তিনি বলেন, সে সময় রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নক্সা প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করেন তিনি। শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক পাঁচ-আট কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার হয়। প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নক্সা করা হয়েছিল। পরে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখার বিষয়টি যুক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, সংশোধিত ডিপিপিতে বেশি ভার বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন রেল সংযোগ যুক্ত করা হয়। কংক্রিটের বদলে ইস্পাত বা স্টিলের অবকাঠামো যুক্ত হয়। সেতু নির্মাণে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি গভীরতা ধরা হয়। বৃদ্ধি পায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ব্যয়ও। সেতু নির্মাণকালীন দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে সময়কার দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রতিশ্রুত অর্থ প্রত্যাহার করে নিলে অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও তখন সরে দাঁড়ায়। যদিও পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার একটি আদালতে মিথ্যা ও ভুয়া বলেই প্রমাণিত হয়। আর নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।
সে সময় দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, আমি জানি তখন আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা ছাড়া এই সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে না, যে কথাটি আমাকে বার বার শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিজস্ব অর্থায়নে সেতু করতে পারলে তবেই করব, কারও কাছে হাত পেতে করব না এবং বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াবে ও নিজেই করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সেতু নির্মাণ করতে গেলে দেশীয় রিজার্ভের ওপর চাপ আশার যে আশঙ্কা ছিল সেখানে তাঁর একটা হিসাবে ছিল যে, সেতুটি নির্মাণে প্রায় ৬ থেকে ৭ বছর সময় লাগতে পারে এবং সে সময়ে বছরে ৫০ মিলিয়ন ডলার করে যদি ব্যয় করা যায় তাহলে রিজার্ভে কোন চাপ পড়বে না। নিজস্ব অর্থায়নে তাঁর সেতু নির্মাণের ঘোষণায় দেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসার কথাও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, কানাডার কোর্ট যখন বলে দিল পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি তখন মানুষের মাঝে একটা অন্যরকম চেতনা আসল। আর সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। আর এক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার কোন পথ ছিল না। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশ যাতে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে তার স্বর্ণদুয়ারও উন্মোচন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যেভাবে উন্নতি হয়েছে, তাতে এই সেতু আমাদের জন্য অনেক লাভজনক হবে। আমাদের অনেক বেশি উন্নতি হবে বলে বিশ্বাস করি। পদ্মা সেতুর সফল সমাপ্তিতে আমাদের বেশকিছু প্রাপ্তি যুক্ত হবে। এই সেতু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে স্বকীয়তা বজায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে।