ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যুগ ॥ অগ্রযাত্রার ভিত্তি

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ২১ অক্টোবর ২০১৭

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যুগ ॥ অগ্রযাত্রার ভিত্তি

এক যুগ অতিক্রম করল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি ১২ বছর অতিক্রম করে ১৩ বছরে পদার্পণ। কিন্তু আমি মনে করি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এক অর্থে ১২ বছর পূর্ণ হয়নি। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই ২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। জগন্নাথ কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরের পর ২০১১ সাল পর্যন্ত এখানে কলেজের শিক্ষকবৃন্দই ছিলেন। মূলত কলেজের শিক্ষকবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়েছেন। ২০১১ সালের পর থেকে কলেজের শিক্ষকবৃন্দ প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিদায় নেন। সাধারণত বয়স দুই ধরনের হয়ে থাকে, এক. ক্যালেন্ডারভিত্তিক বয়স, দুই. মানসিক বা বুদ্ধিভিত্তিক বয়স। এদিক বিবেচনা করলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স মাত্র ৬ বছর। তারপরও জন্মের তারিখ থেকে হিসাব করলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১২ বছর। এই এক যুগের পথচলার সাথী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও এক যুগের অভিনন্দন। ১২ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কালচারাল পরিবর্তন সাধন করা। কলেজের নিজস্ব কালচার বিদ্যমান থাকে। কলেজ তৈরি হয় মূলত জ্ঞান বিতরণের জন্য। আমাদের দেশে কলেজে জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ নেই। কলেজের কালচার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমরা গুরুত্বসহকারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি প্রবর্তনের জন্য এমফিল, পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার মধ্যদিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করি। এর অংশ হিসেবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হচ্ছে গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ শতাধিক এমফিল, পিএইচ.ডি গবেষণা তত্ত্বাবধানের বাইরেও ইউজিসি ও সরকারী অর্থায়নে এক শ’র অধিক গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছেন। বেশ কয়েকটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনও আমাদের হাতে জমা হয়েছে। শিক্ষকবৃন্দ এসব গবেষণা প্রকল্প থেকে বিশ্বমানের প্রকাশনা তৈরি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদের জার্নাল নিয়মিত বের হচ্ছে। অতীতে জার্নাল ছাড়া আমাদের অন্য কোন প্রকাশনা ছিল না। এবার আমরা ১২ বছরে এসে প্রকাশনা কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে গবেষণাধর্মী মনোগ্রাফ বা প্রতিবেদন বই আকারে বের হচ্ছে। ছাপার কাজ প্রায় শেষ। কয়েকদিনের মধ্যে পাঁচটি গবেষণাধর্মী বই আমাদের হাতে আসবে। আরও কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদন রিভিউয়ারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বইগুলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব খরচে ছাপানোর ব্যবস্থা করছি। আমি মনে করি, এটি আমাদের বড় মাইলফলক। এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে। শিক্ষকরাও মেধাবী। অর্থাৎ মানবসম্পদের কোন সঙ্কট বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। কেবল মেধার ওপর ভিত্তি করেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর প্রায় ক্ষেত্রেই এ নবীন বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান রানার আপের। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে অবকাঠামোগত সঙ্কট। শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষকদের বসার ব্যবস্থা, বিশেষ করে ল্যাবরেটরি এবং গ্রন্থাগারের সীমাবদ্ধতা এখনও প্রকট। প্রকৃত অর্থে সত্যিকারের গবেষণা করার মতো ল্যাবরেটরি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। যদিও আমরা ই-লাইব্রেরি সংযুক্ত করেছি। কিন্তু সেই পরিমাণ আকর্ষণ তৈরি করা, লাইব্রেরিতে যথেষ্ট জার্নাল, বইয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। ইতোমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিডি-রেন নামে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আশা করা যায়, আগামী ডিসেম্বর মাসের পর থেকে আমরা হাইস্পিড ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হব। এতে আন্তর্জাতিক জার্নাল, প্রকাশনা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজে দ্রুত সংযোগ ঘটবে। অবকাঠামোগত সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমানে ক্যাম্পাসে বড় কিছু করার সুযোগ নেই। বর্তমান ক্যাম্পাসে একাডেমিক ভবনের উর্ধমুখী সম্প্রসারণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে নতুন ভবনের দুই-তিনটি ফ্লোর প্রস্তুত হয়েছে। দুই-এক মাসের মধ্যে আমরা ব্যবহার করতে পারব। বাকিগুলোর কাজ দ্রুত চলছে। এদিকে মেয়েদের হলের ১০ তলার কাঠামো নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে যথেষ্ট জায়গা না থাকার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহে কেরানীগঞ্জে আধুনিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত সুবিধাসমৃদ্ধ একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কেরানীগঞ্জের তেঘড়িয়া ইউনিয়নে প্রায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে। জমি অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট কার্যাদি চলছে। জমির নক্সা প্রণয়নও চূড়ান্ত হয়েছে। অপরদিকে প্রায় ২০০ একর জায়গার ওপর বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজও অব্যাহত রয়েছে। দেশের একটি খ্যাতনামা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছামূলকভাবে আমাদের কনসেপ্ট পেপার তৈরি করে দিচ্ছে। পরবর্তী পর্যায়ে বিশেষজ্ঞরা সেটা ব্যবহার করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চূড়ান্ত একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করবেন। জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হলেই আমরা খুব দ্রুত ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সীমানা প্রাচীর নির্ধারণ, খাল খননসহ অন্য জরুরী স্থাপনা, একাডেমিক ভবন, বিশেষ করে ছাত্রদের হল নির্মাণের বড় প্রস্তাবনা সরকারের কাছে প্রেরণ করব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, অর্থের কোন অভাব হবে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার জন্য যত খরচ হোক না কেন, সরকার তা বহন করবে- এমনটিই সিদ্ধান্ত হয়েছে একনেকের বৈঠকে। আমরা ঠিক সেভাবেই সার্বিক কাজ অব্যাহত রেখেছি। আমরা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করছি না। প্রত্যেক দিনই কাজ চলছে। এবার ১২ বছর পূর্তিতে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বাসের সংযোজন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট বাস ছিল না। ইতোমধ্যে তিনটি বাসের অর্ডার দেয়া হয়েছে। বাস তিনটি পাওয়া গেলে শিক্ষার্থীদের ট্রিপ এবং রুট সংখ্যা বাড়ানোর দাবি অনেকটাই পূরণ হবে। আশা করি, বাস তিনটি পাওয়ার পর আমরা আরও বাস সংগ্রহ করব। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতদিন পর্যন্ত আবাসিক সমস্যার সমাধান না হবে, ততদিন পর্যন্ত নতুন বাস ক্রয় এবং ভাড়া বাস বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। তিনটি বাস পাওয়ার পর আরও দুটি বাসের অর্ডার দেয়া হবে। শিক্ষকদের জন্য আরও গাড়ি সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। কিছুদিনের মধ্যে সংযুক্ত হবে নতুন একটি মিনিবাস। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১১৫ মেধাবী এবং তরুণ শিক্ষক পিএইচডি ও উচ্চতর ডিগ্রী করার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। তাদের অধিকাংশই উত্তর আমেরিকা, কোরিয়া, জাপান এবং চীনসহ নানা দেশে অধ্যয়ন করছেন। অনেকে আবার ডিগ্রী সম্পন্ন করে ফিরেও এসেছেন। বাকিরা ফিরে আসলে আধুনিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যে মানবসম্পদ দরকার, আমরা তা পেয়ে যাব। আগামী দুই বছরের মধ্যে জায়গা, শ্রেণী, ল্যাবরেটরি ও গ্রন্থাগারসহ অবকাঠামো সঙ্কট কিছুটা কমবে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের সম্মিলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একুশ শতাব্দীর সত্যিকারের গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ পাবে। আর অধিকতর ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য যেসব শর্তের প্রয়োজন আমরা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই মিলে তা পূরণের চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে সরকার আমাদের যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করছে। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×