ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুয়াকাটায় থমকে আছে উদ্ধার প্রক্রিয়া

জালিয়াতচক্রের দখলে খাস জমি

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জালিয়াতচক্রের দখলে খাস জমি

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২৯ সেপ্টেম্বর ॥ কুয়াকাটায় খাস জমি বিক্রি করে কয়েকটি চিহ্নিত চক্র শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুয়া খতিয়ান খুলে বেদখল হওয়া এসব খাস জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়াও এখন থমকে আছে। ফলে প্রকৃত লগ্নিকারকরা পড়েছেন বিপাকে। আর সরকারের এ জমি উদ্ধার প্রক্রিয়া এখন ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ছে। এসব জমি উদ্ধারে সরকারের নির্দেশনা আটকে আছে প্রায় সাত বছর। কুয়াকাটাকে পরিকল্পিতভাবে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। যার প্রাথমিক ধাপ হিসাবে পৌরসভা গঠন করা হয়েছে। প্রথম পৌর মেয়র-কাউন্সিলর নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে মাস্টারপ্ল্যান। ফলে কুয়াকাটার ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার জমির ওপরে নজর পড়েছে আবাসন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। বিশেষ করে কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকায় এখন এক শতক জমির মূল্য প্রায় দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত। নবগঠিত কুয়াকাটা পৌরসভার অবস্থান লতাচাপলী মৌজায়। এ মৌজায় সরকারী হিসেবে দেড় শহস্রাধিক খতিয়ান রয়েছে। যার মধ্যে ১১৫৭টি রয়েছে প্রিন্টেড খতিয়ান। বাকিসব ভুয়া খতিয়ান বলে দাবি স্থানীয়দের। এর সংখ্যা অন্তত ২০০। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণ করা জমি পর্যন্ত দখল করা হয়েছে। সূত্রমতে, ১১৫৮ থেকে ১৩৫৮ পর্যন্ত এই খতিয়ানের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সরকারী খাস জমি জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভূমি অফিসের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে একটি চিহ্নত চক্র বহু আগেই ভুয়া লুজ খতিয়ান খুলে সরকারের সহস্রাধিক একর খাস জমি হাতিয়ে নিয়েছে। যার মূল্য বর্তমানে হাজার কোটি টাকা। এসব খাস জমি বেচাকেনার দালালিতে লতাচাপলী ও কুয়াকাটা তথা কলাপাড়া উপজেলার প্রায় দুই শ’ দালাল রয়েছে। এর মধ্যে লতাচাপলী ও ধুলাসার ইউনিয়নে রয়েছে প্রায় দেড় শ’ জন। এদের রয়েছে অন্তত ৫০ সদস্যের একটি দালাল চক্র। এরা মূলত কাগজপত্র তৈরি থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করে দেয়। এসব চিহ্নিত চক্রের আর কোন কাজ না থাকলেও প্রতিদিন অসংখ্যবার ভূমি অফিসে যাতায়াত রয়েছে। এই চক্রের দৌরাত্ম্যে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারী পর্যন্ত অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে। এরা অফিসের রেকর্ড পর্যন্ত নষ্ট কিংবা গায়েব করে দিয়েছে এমন এন্তার অভিযোগ রয়েছে। ২০১১ সালের প্রথমদিকে সরকারীভাবে লতাচাপলী, চরচাপলী, কাউয়ারচর ও গঙ্গামতি মৌজার খাস জমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। এই নির্দেশনায় বেনামে ভূমিহীন সাজিয়ে বন্দোবস্ত কেস খাস জমি উদ্ধারে পর্যটন এলাকা কুয়াকাটায় ভূমিহীনদের নামে দেয়া ত্রুটিপূর্ণ বন্দোবস্ত কেস শনাক্ত করতে গঠিত বিশেষ কমিটি কাজ শুরু করে। ২০১১ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ৭ এপ্রিলের ২৬৯ নম্বর স্মারকে পটুয়াখালীর জেলাপ্রশাসক ৯ মে এক চিঠিতে এলক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের গঠিত এই কমিটির প্রধান হলেন, অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। এছাড়া এই কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর পটুয়াখালী, কলাপাড়া ভূমি অফিসের কানুনগো এবং এসএ শাখার সার্ভেয়ার। এছাড়া কলাপাড়ার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্য সচিব করা হয়েছে। ওই কমিটির নির্দেশনায় তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল আউয়াল প্রায় ৯০০ বন্দোবস্ত কেস যাচাই-বাছাইয়ের জন্য শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এ কাজের অগ্রগতি রহস্যজনকভাবে থমকে আছে। সূত্রমতে, খাস জমি দখল চক্রের মূল হোতারা সরকারের শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত করেছে। এর মধ্যে ১৩৪৬ খতিয়ানের চার একর ৭৭ শতক খাস জমি হাতিয়ে নেয়ার খবরটি এখন সর্বত্র আলোচিত রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ জেলা উপজেলা ভূমি প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে পর্যটন এলাকার হাজার কোটি টাকার সরকারী সম্পতি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নয়তো ১৩৪৬ খতিয়ানটি এসপি নম্বর ৫০-কে ৫৩/৫৪ সেটেলমেন্ট কেসের মাধ্যমে মিস কেস ৭১ কে-৬০/৬১ এর মাধ্যমে মালেক ফরাজি গংদের নামে মালিকানা দেখানো হয়। অস্পষ্ট, কাটাছেঁড়া লেখা রয়েছে বইতে। এই জমির ওপরে একটি স্থাপনা নির্মাণ কাজ প্রশাসনের নির্দেশনায় কিছুদিন বন্ধ থাকে। ২০০৪ সালের ৯ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএ-৩-১১/পটু-২০০৩/১৯২৭ স্মারকে এবং উপজেলা ভূমি অফিসের ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবরের ৯৬৬ স্মারকে খতিয়ানটির মালিকানা বাতিল করা হয়। ঘোষণা করা হয় সরকারী খাস জমি। ইতোপূর্বে এই জমির ভাগাভাগি নিয়ে কলাপাড়া উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা হয়। ওই মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যার নামে এই জমি বন্দোবস্ত দেখানো হয়েছে তার (মালেক ফরাজী) ৫৩/৫৪ সালে বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। এ জমিতে এখন একজন কাউন্সিল বাড়িঘর করেছে। চলছে একাধিক বহুতল স্থাপনা তোলার কাজ। একই অবস্থা ১২৭০সহ একাধিক জাল খতিয়ানের। এসব সরকারী খাস জমি উদ্ধারে স্থানীয় ভূমি প্রশাসনের নেই কোন তৎপরতা। মানুষের অভিমত, এখনও প্লেন ল্যান্ড রয়েছে এখানকার অধিকাংশ জমি। পরবর্তীতে অবকাঠামো গড়ে তুললে এসব জমি উদ্ধারে জটিলতা আরও বাড়বে বলে মন্তব্য সকলের। সচেতন মহলের দাবি এসব খাস জমি উদ্ধার করে নবগঠিত পৌরসভা ভবনসহ বিভিন্ন অফিস স্থাপন করতে সরকারের প্রতিবন্ধকতার কবলে পড়তে হবে না। তাই এখনই সরকারের খাস জমি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরী প্রয়োজন।
×