ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা নির্যাতন এই বর্বরতার শেষ কোথায়?

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা নির্যাতন এই বর্বরতার শেষ কোথায়?

মিয়ানমারে সন্ত্রাস দমনের নামে নির্বিচারে চলছে গণহত্যা। সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো বর্বরতা থেমে নেই। প্রতিনিয়ত চলছে এ হত্যাযজ্ঞ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এমন বর্বরতায় লাখ লাখ মানুষ হয়েছে গৃহহীন, আশ্রয়হীন। সহায় সম্বল হারিয়ে অসহায় মানুষগুলো ধ্বংসের দিগন্ত ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলেছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত, পেছনে ফেলে আসা ধ্বংসের দিগন্ত, স্বজন হারাবার দুঃসহ স্মৃতি আর অব্যক্ত বেদনার আহাজারি বয়ে বয়ে ক্লান্ত পথিকের ন্যায় ছুটে চলছে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তিন লক্ষাধিক মানুষ। নো ম্যানস ল্যান্ডে এখনও অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। নাফ নদী পার হতে গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় শ’খানেক মানুষ, নিখোঁজ রয়েছে আরও বেশকিছু। মিয়ানমার সরকারের এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু হওয়ার পর বর্বর সেনাবাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে প্রায় চার সহস্রাধিক মানুষ। প্রতিদিন নির্মম হত্যাযজ্ঞে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। প্রকৃত ঘটনা হয়তোবা আরও ভয়াবহ। তাই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলকে মিয়ানমারে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বরং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্ত এলাকাজুড়ে স্থলমাইন স্থাপন করা হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে বিশ্ববিবেক। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এই বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছে, বর্বরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনগুলোও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে। এমনকি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক এবং শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত নেত্রী আউং সান সুচির নোবেল কেড়ে নেয়ারও দাবি উঠেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার কোন কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। দিন দিন এই বর্বরতা বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি কেন এই নির্মমতা, কেন এই নিষ্ঠুরতা, কেন এই বর্বরতা, কেন এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস এবং তাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের অমানবিক আচরণের প্রতি একটু দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি ভাগ্যহত জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় বিশ্বাসে এরা অধিকাংশই মুসলমান। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীও সেখানে রয়েছে। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশই রোহিঙ্গা। আমার মনে হয় এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে নিগৃহীত, নিষ্পেষিত মানবগোষ্ঠী। কারণ তাদের কোন রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের স্বীকৃতি নেই। অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। মিয়ানমার সরকার ১৩৫টি জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে তাও জোটেনি। মিয়ানমার সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুযায়ী বিদেশীরা কোন ভূমি ও সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। ওই সরকারের দৃষ্টিতে রোহিঙ্গারা অবৈধ অভিবাসী তথা বিদেশী। তাই তারা কোন ভূমি বা সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে রোহিঙ্গারা যে সব ভূমিতে বসবাস করছে মিয়ানমার সরকার যে কোন সময় তা কেড়ে নিতে পারে। এই আইন রীতিমতো অসহনীয় করে তুলেছে রোহিঙ্গাদের জীবন। তারা কোন সরকারী চাকরি করতে পারে না, সরকারী কোন দফতরের সেবা তারা পায় না। ব্যাংকে লেনদেন করতে পারে না, চিকিৎসাসেবা পায় না। বিদ্যুত পায়নি, জ্বালানির জন্য আবেদন করতে পারে না, রোহিঙ্গা পরিচয়ে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। এজন্য রোহিঙ্গাদের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই অশিক্ষিত। মিয়ানমার সরকার কর্তৃক প্রতিনিয়তই রোহিঙ্গাদের উপর চলে নিপীড়ন। রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে খাটানো হয়। প্রায়শ স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন লোকালয়ে হানা দেয়। শহরের সৌন্দর্যবর্ধন, সরকারী জমি অধিগ্রহণের নামে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা হয়, তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোও ভেঙ্গে ফেলা হয়, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া হয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা অনেকটা দাসপ্রথার ন্যায় জীবন ধারণ করে। রোহিঙ্গাদের জন্য রয়েছে গ্যাটো জাতীয় বিশেষ ধরনের জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বেশ কয়েকটি স্থানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওরা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বের হতে পারে না। সেই গ্যাটোগুলোর ভেতর আবদ্ধ অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করে রোহিঙ্গারা। আবার গ্যাটোর বাইরেও থাকতে পারে না তারা, কারণ তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তাদের অবস্থা এমন যে তারা নিজ দেশে পরবাসী। মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের প্রতি এই আচরণ ১৯৪০ সালের ১৮ ডিসেম্বর সম্মিলিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ‘মানুষের মৌলিক অধিকার’ সনদের পরিপন্থী। ওই সনদের ২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই ঘোষণায় যেসব অধিকার ও স্বাধীনতার কথা উল্লেখ আছে প্রত্যেক মানুষের সে সব অধিকার ও স্বাধীনতা থাকবে এবং এ ব্যাপারে বংশ, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্যকোন মতামত জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, সম্পদ, জন্ম বা অন্য কোন কারণে মর্যাদার ভেদাভেদ হবে না। তাছাড়া যে, যেই দেশে বাস করে সে সেই দেশের নাগরিক। রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক মর্যাদার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে কোন তারতম্য করা হবে না। সে দেশ স্বাধীন হোক, স্বায়ত্তশাসিত হোক বা ক্ষমতাহীন হোক যত ত্রুটিই থাকুক এসব অধিকার ও স্বাধীনতার ব্যাপারে মানুষে মানুষে কোন তফাৎ থাকবে না।’ জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত পৃথিবীর সব রাষ্ট্র এ সনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের এ ধরনের আচরণ ‘মানুষের মৌলিক অধিকার’ সনদের চরম লঙ্ঘন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে জাপান বার্মা আক্রমণ করে। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র বার্মায় জাপানী সেনাদের হাতে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তখন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে চট্টগ্রামে পাড়ি জমিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে স্বাধীনতার সুফল জোটেনি। বরং ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৮ সালে জেনারেল নে উইন বার্মার রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ পরিচালনা করেন। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। পরবর্তীতে সামরিক সরকার কিংবা গণতান্ত্রিক সরকার যারাই ক্ষমতায় এসেছে রোহিঙ্গাদের সমস্যা মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে কেউ বিচার করেনি, কিংবা সমাধানের চেষ্টা করেনি। বরং তাদের নির্মূল করার চেষ্টাই করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে বংশানুক্রমে আরাকান (বর্তমান রাখাইন) রাজ্যে বসবাস করে আসছে। সে দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া তাদের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলো যখন তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছে তখনই মিয়ানমার সরকার এবং সে দেশের বর্বর সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের উপর। বর্তমানে মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের সেনাবাহিনী যা করছে তা একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করারই অপচেষ্টা। এর বিরুদ্ধে বিশ্বের বিবেকবান মানুষগুলোকে আরও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। ধর্ম বর্ণের ভিত্তিতে নয়, মানুষ হিসেবে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধান হওয়া উচিত। লেখক : বীমা ব্যক্তিত্ব সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম
×