মাটির সোঁদা ঘ্রাণ টেনে নেয় মাটির মানুষকে। সেই কবে গত শতকের ষাট দশকে গেয়েছিলেন শিল্পী, ‘মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে, এ মাটির গান গেয়ে ভাই জীবন কেটেছে।’ মাটিকে শিল্পিত করে তোলার কাজে নিবেদিত যারা, তাদের রক্ত মাংস মজ্জায় সুন্দরের সুঘ্রাণে সৌন্দর্যের আবরণে নতুন সৃষ্টির ভুবন তৈরি হয়। মাটি হয়ে যায় তখন মৃৎশিল্প। সহস্র বছর ধরেই এই শিল্প চর্চিত হয়ে আসছে এই ভূ-ভারতে তথা উপমহাদেশে। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রান্তে কুমারেরা বসবাস করে। মাটির পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল, সরা, বাসন, ঘরা, কলসি, বদনা, ঠিলা, ঘটির কদর ছিল সর্বত্র এই বাংলায়। প্রতিটি ঘরে ও সংসারে এসব নিত্য ব্যবহার্য হয়ে আসছিল হাজার বছর ধরে। মাটি খনন করে যে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করা হচ্ছে, সেখানে মৃৎশিল্পের নানা পণ্যের দেখা মিলছে। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের মানুষ মৃৎশিল্প নির্ভর জীবনযাপন করে আসছে। কুমার সম্প্রদায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। হাতের সুনিপুণ হাতের কারুকাজ ফুটে ওঠে মৃৎশিল্পে। শৈল্পিক হাতে তৈরি পণ্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করা হতো। হাট-বাজারে সারা বছরই বিক্রি চলত। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, ফাল্গুন ও চৈত্রÑ এই চার মাস মৃৎশিল্পের তৈরি পণ্যের চাহিদা একটু বেশি থাকে। বাকি আট মাস বেচা-বিক্রি তেমন হয় না। বংশ পরম্পরায় কুমাররা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বর্তমানে এ পেশা দিয়ে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। উৎপাদিত পণ্যের আর তেমন চাহিদা নেই। এসবের ব্যবহারও হয়ে পড়েছে সীমিত। পহেলা বৈশাখসহ গ্রামীণ মেলায় কিছু বিক্রি-বাট্টা হয়। শখের বশে অনেকে ঘর সাজানোর জন্য কিনে থাকেন।
মৃৎশিল্পের প্রধান কাঁচামাল মাটির সঙ্কটও রয়েছে। ইটভাঁটিতে মাটি বেশি দামে বিক্রি হয় বলে ভূমি মালিকরা মৃৎশিল্পীদের কাছে বিক্রিতে আগ্রহী হয় না। ফলে কুমাররা মাটির অভাবে পণ্য উৎপাদন করতে পারে না। মৃৎশিল্পের এই দুরবস্থার কারণ মূলত প্লাস্টিক পণ্যের সুলভ সরবরাহ। বাজারে নিত্যনতুন শিল্প সামগ্রীর প্রসার ঘটছে। যা আবার টেকসই। কিন্তু মৃৎশিল্প ভঙ্গুর, তাই এর প্রতি আগ্রহ কমে এসেছে। প্লাস্টিক পণ্যের জয়জয়কার এখন বিশ্বজুড়ে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য প্রায় সবকিছুই এখন প্লাস্টিকের তৈরি। স্বল্পমূল্যে তা পাওয়া যায়। প্লাস্টিকের তৈরি পলিথিনের ক্রয় বিক্রয় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও তা থেমে নেই। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পূর্ণোদ্যমে চলছে এর ব্যবহার। মূলত মাটির তৈরি জিনিসপত্রের জায়গাটা দখল করেছে প্লাস্টিক। যদিও এসব পণ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের অন্যতম উপাদান এই প্লাস্টিক বর্জ্য। বিভিন্ন নগর-মহানগরে বর্তমানে বৃষ্টি হলেই যে জলাবদ্ধতা হয়, তার অন্যতম কারণ এই প্লাস্টিক বর্জ্য। এগুলো বিনষ্ট হয় না। নালা নর্দমায় আটকে থাকার কারণে পানি সরতে পারে না। থালা, বাসন, মগ, বালতি, বাটি, ঘটি, বদনা, গ্লাস, টিফিন বক্সসহ প্লাস্টিক তৈরি পণ্যের চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। ওজনের দিক থেকেও মৃৎশিল্পের চেয়ে অনেক হাল্কা। পরিবেশবিদদের মতে, প্লাস্টিক বর্জ্য দেশের ইকোসিস্টেমে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। আবার মাটিতেও মিশে যেতে পারে না এই বর্জ্য। কিংবা আগুনে পোড়ালে যে গ্যাস উৎপন্ন হয় তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ক্যান্সারসহ নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার ঘটাতে এ পণ্য বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখে আসছে। এই ক্ষতিকর পণ্য এসে মৃৎশিল্পকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে প্রায়। এ পেশায় জড়িতরা অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মাটির তৈরি যে কোন পণ্য পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যসম্মত হলেও মানুষ এর ব্যবহার থেকে সরে যাচ্ছে। অপরদিকে মৃৎশিল্পের চাহিদা হ্রাস এবং উপকরণ মাটির দাম বেড়ে যাওয়ায় কারিগররা বেকার হয়ে পড়ছে। সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং এর ব্যবহার নিয়ে জনসচেতনতা না বাড়ানোর ফলে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অথচ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্পের বিশাল বাজার আবারও তৈরি হতে পারে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য গুরুত্ব যে অপরিসীম, সে বোধ জাগিয়ে তোলাও জরুরী। গ্রাম বাংলার জীবনে ব্যবহার্য মৃৎশিল্পকে জাগিয়ে তোলার জন্য দরকার পরিকল্পনা। পরিকল্পিতভাবে উৎপাদন করা গেলে এবং ব্যবহার বাড়ানো হলে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক হ্রাস পাবে। দেশীয় পণ্যের ব্যবহারে মানুষ আবার আগ্রহী হবে। মাটির গান প্রতি ঘরে ঘরে আবার বেজে উঠুক। কুমাররা প্রাণ খুঁজে পাক তাদের সৃষ্টিশীলতায়Ñ তেমন দিন আবার আসুক, এমন প্রত্যাশা থাকেই।
শীর্ষ সংবাদ: