ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক পিতার বোবা কান্না

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১২ আগস্ট ২০১৭

এক পিতার বোবা কান্না

বুকে পাথর চেপে আছেন তিনি। স্বাভাবিক কথায় থেই হারিয়ে ফেলেছেন। তার স্ত্রীর বোবা কান্না। কখনও গুমরে ওঠে। কখনও নীরবেই অশ্রু বিসর্জন। ভুলতে পারেন না তারা একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলের অস্বাভাবিক মৃত্যু। দোষারোপ করেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ইসলামকে। ২০১৩ সালের ৩ মার্চ এই দলটির প্রতারণা বার্তা ছিল ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে।’ জামায়াতের প্রতারণায় বগুড়ার হুজুগে মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে মাঠে নামে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বাধ্য হয় গুলি চালাতে। সেই গুলিতে নিহত হয় বগুড়া জয়পুরপাড়া এলাকার নিরীহ তরুণ আব্দুল্লাহ আল মামুন বাদল। তখন তার বয়স ২৪। বাইরের শোরগোলে সকাল বেলা জেগে ওঠে সে। এ সময় আকস্মিক পুলিশের গুলি বিঁধে যায় বাদলের দেহে। তখন এমন অবস্থা যে বাদলকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করে হাসপাতালে নেয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। এই বাদলই ছিল শহরতলির জয়পুরপাড়ার আলতাফ হোসেন ও আয়েশা আখতার দম্পতির দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে একমাত্র ছেলে। ওই সময়ে সে বগুড়ার একটি দোকানের কর্মচারী ছিল। আলতাফ হোসেনের গ্রামের বাড়ি গাবতলীর নাংলু গ্রামে। চাকরি করতেন জনতা ব্যাংকে। ১৯৮২ সালে জনতা ব্যাংক ঢাকার পল্টন বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় চাকরি করাকালীন ব্যাংক কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগ দেন। সাত্তার সরকারের শাসনামলে এক নোটিশে আন্দোলনরত ব্যাংক কর্মচারীদের বরখাস্ত করলে আলতাফ হোসেনও চাকরি হারান। পরে অনেক দেন-দরবার করেছেন। সরকারের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিয়েছেন। চাকরি ফিরে পাননি। দিনে দিনে সর্বস্ব হরিয়ে এক পর্যায়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। সংসারে নেমে আসে দুর্দিন। সংসার চালানোর দগ্ধতা, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া চালানোর খরচের ভাবনা সামনের দিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে। এর মধ্যেই তিনি যতটুকু পারেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালান। এক পর্যায়ে ছেলে বাদল লেখাপড়া ছেড়ে দোকানের কর্মচারীর চাকরি নেয়। ছেলের রোজগার সিন্ধুতে বিন্দুর মতো হলেও দরিদ্রতায় কিছু আর্থিক সঙ্গতি হয়। ...এভাবেই কাটতে থাকে তাদের জীবন। চার বছর আগে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ তাদের উপার্জনক্ষম ছেলে মারা যায়। সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। এমন দুরবস্থা দেখে বগুড়ার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল হামিদ আলতাফ হোসেনকে ঢাকায় নিয়ে যান। শ্যামলী শিশু মেলার পশ্চিম ধারে নবনীড় সরকারী কর্মকর্তাদের আবাসনে অফিস সেক্রেটারি ও সুপারভাইজারের চাকরির সুপারিশ করেন। সেখানে স্বল্প বেতনের চাকরি জোটে আলতাফ হোসেনের। তিনি থাকেন ঢাকায়। পরিবার থাকে বগুড়ায়। এমন দুরবস্থা ও দরিদ্রতার মধ্যে দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসী জান্নাত ও রাবেয়া বুশরা বৃষ্টির লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। জান্নাত বগুড়া সরকারী মজিবর রহমান মহিলা কলেজে সম্মান চতুর্থ বর্ষের এবং বৃষ্টি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আলতাফ হোসেনের বয়স এখন ৬২ বছর। বার্ধক্যে যতটা না নুয়ে পড়েছেন সন্তান হারানোর দংশন ও দরিদ্রতার ক্ষত তাকে কাবু করে ফেলেছে। দৈন্যের কথা কাউকে বলেন না। সন্তান শোকে বুকে যেমন পাথর চাপা দিয়েছেন, জীবনের কথাগুলো চেপে রাখেন। তার স্ত্রী আয়েশা আখতারের বোবা কান্না কেউ শোনে না। তারা তাকিয়ে আছেন আগামীর দিকে...। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×