ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ॥ ভরসাস্থল কর্মজীবী মায়েদের

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৭ মে ২০১৭

শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ॥ ভরসাস্থল কর্মজীবী মায়েদের

আনোয়ার রোজেন ॥ রাহাতুল ইসলাম ও নাজনীন আকতার দুজনই চাকরি করেন। তাদের একমাত্র ছেলের বয়স দুই বছর। একক পরিবার। ছেলের দেখভাল করতে পারবেন- আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য এমন কেউ নেই। এদিকে বিশ্বস্ত গৃহকর্মীরও অভাব। এছাড়া গৃহকর্মীর কাছে থাকলে সন্তানের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠাও অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে নাজনীন আকতারের চাকরি চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল। এমন অবস্থায় ছেলেকে শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশন ডে-কেয়ার সেন্টারে (দিবাযতœ কেন্দ্র) রাখার পরামর্শ দেন নাজনীনের এক নারী সহকর্মী। কর্মস্থলের কাছে হওয়ায় একদিন স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে দিবাযতœ কেন্দ্রটি ঘুরে আসেন। সেখানকার পরিবেশ, শিশুদের দেখভালকারীদের দায়িত্বশীলতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে আশ্বস্ত হয়ে ছেলেকে রাখার সিদ্ধান্ত নেন স্বামী-স্ত্রী। নাজনীন এখন অনেকটা চিন্তামুক্ত হয়ে অফিস করতে পারেন। তিনি বললেন, কর্মস্থল বা তার আশপাশে যদি এমন ডে- কেয়ার সেন্টার থাকে তাহলে চিন্তামুক্ত থাকা যায়। বাড়িতে ছোট শিশুর যখন তখন বিপদ হতে পারে। এছাড়া চুলার আগুন, গরম পানি, ধারালো জিনিস ইত্যাদি থেকে পদে পদে বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই শিশুকে সার্বক্ষণিক একজন নির্ভরযোগ্য মানুষের তত্ত্বাবধানে রাখতে পারলে সবচেয়ে নিরাপদ থাকা যায়। কিন্তু এ যুগে চাইলেই অমন একজন কাজের মানুষ পাওয়া মুশকিল। নাজনীনের বক্তব্যেই স্পষ্ট- কর্মজীবী মায়ের শিশুটিকে নিরাপদে ও যতেœ রাখার জন্য দিবাযতœ কেন্দ্র কতটা প্রয়োজন। সরকারী উদ্যোগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দিবাযতœ কেন্দ্র চালু আছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এর সংখ্যা এখনও অনেক কম। মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের আওতায় সরকারী খাতে রাজস্ব বাজেটে ৩২টি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১১টি অর্থাৎ মোট ৪৩টি দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এই পাঁচ বিভাগীয় শহরে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। মহিলাবিষয়ক অধিদফতর বলছে, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে কর্মজীবী নারীর অংশগ্রহণের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছয় মাস থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক দিবাযতœ কেন্দ্র না থাকায় নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মায়েদের কর্মদক্ষতা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে পর্যাপ্ত ও প্রতিটি জেলায় একটি করে দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটিতে আরও ১০টি এবং ১০ জেলা সদরে ১০টি অর্থাৎ মোট ২০টি শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশের সব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর শিশুসন্তানদের জন্য শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র তৈরির নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে বেসরকারী উদ্যোগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দিবাযতœ কেন্দ্র চালু আছে এবং হচ্ছে। মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সাহিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হলো কর্মজীবী মায়েদের ছোট সন্তানদের দিবাকালীন সেবা প্রদানের মাধ্যমে মায়েদের নিজ কর্মস্থলে নিশ্চিন্তে কাজ করার সুযোগ দান। এসব কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সব সুবিধা শিশুদের জন্য রাখা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের আওতায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিশুদের জন্য দু’ধরনের দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। রাজধানীতে বাড্ডা, আদাবর, ডেমরা, গাবতলী, মগবাজার, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, আজিমপুর, সূত্রাপুর, টঙ্গী ও কামরাঙ্গীরচরে নিম্নবিত্তদের জন্য এবং বাংলাদেশ সচিবালয়, এজিবি অফিস, আজিমপুর, ইস্কাটন, সেগুনবাগিচা, খিলগাঁও, উত্তরা, মিরপুর ও পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে মধ্যবিত্তদের জন্য দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রের প্রতিটিতে একসঙ্গে ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ শিশুকে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের যথাযথ শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য সুষম খাবার প্রদান, ইপিআই প্রতিষেধকসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, প্রাক-স্কুল শিক্ষা প্রদান এবং ইনডোর খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের সুবিধা রয়েছে। শিশুদের জন্য এসব কেন্দ্রে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার ও বিকেলে ফলমূল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পরিকল্পনা কমিশন দিবাযতœ কেন্দ্রের ডে-কেয়ার অফিসার মাহমুদা বেগম জানালেন, কেন্দ্রে ৫০ শিশুকে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে আছে ২৬ শিশু। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী মায়েদের শিশুর পাশাপাশি আশপাশের অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী মায়েদের শিশুও আছে। নাস্তায় এসব শিশুকে দুধ, পাউরুটি, সুজি; দুপুরের খাবারে ভাত, ডাল, শাকসবজি, মাছ এবং বিকেলে কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল দেয়া হয়। একেকদিন করা হয় একেক আইটেম। এছাড়া মাসে একদিন থাকে ‘বিশেষ খাবার’। শিশুদের যতেœ সার্বক্ষণিক একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী ও একজন শিক্ষক আছেন। নারী ও পুুরুষ মিলিয়ে মোট ১২ জন শিশুদের দেখভাল করেন। তিনি আরও জানান, নীতিমালার আলোকে সরকারী-বেসরকারী নির্বিশেষে যে কোন কর্মজীবী মা তার ছয় মাস থেকে ছয় বছর বয়সী সর্বোচ্চ দুই সন্তানকে এ কেন্দ্রে রাখতে পারবেন। শিশুপ্রতি ভর্তি বাবদ এককালীন ৫০০ টাকা এবং মাসিক ফি/চাঁদা হিসাবে ৫০০ টাকা দিতে হয়, যা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারে জমা নেয়া হয়। শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এ কেন্দ্র চালু থাকে। অন্য মধ্যবিত্ত দিবাযতœ কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। তবে নিম্নবিত্ত দিবাযতœ কেন্দ্রে প্রতি শিশুর জন্য মাসিক চাঁদার পরিমাণ মাত্র ১০০ টাকা। সম্প্রতি সরেজমিন পরিকল্পনা কমিশন চত্বর ঘুরে দেখা গেছে, দিবাযতœ কেন্দ্রটির অবস্থান সুপরিসর, পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি জায়গায়। শিশুদের চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় খেলার সামগ্রী, টিভি, ডিভিডি ইত্যাদি। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক শিশু দিবসসহ নানা দিবসে শিশুদের অংশগ্রহণে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিশুরা নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় এখানে। দিবাযতœ কেন্দ্রের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে প্রতি মাসে ‘মাদার্স মিটিং’ করা হয়। সেখানে মায়েরা খোলামেলাভাবে তাদের সন্তানদের যতœ নেয়ার বিষয়ে সেন্টারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করেন। তাদের কোন অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে তারা কথা বলার সুযোগ পান। মাদার্স মিটিংয়ে মায়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, শিক্ষা, স্যানিটেশন, পরিবার পরিকল্পনা, বাল্যবিবাহ, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানদান করা হয়ে থাকে। একই সঙ্গে তাদের মূল্যবান পরামর্শ বিবেচনায় এনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। শিশুর দিবাযতœ কেন্দ্রে অবস্থানের অনেক সুফল রয়েছে বলে মনে করেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ডে-কেয়ার সেন্টারে অবস্থান করায় শিশুর সামাজিক দক্ষতা বাড়ে। পরিবারের বাইরের অন্য শিশু ও অভিভাবকদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। এছাড়া একই সঙ্গে খাওয়ার টেবিলে বসে খাওয়া, খেলার মাঠে যাওয়া বা বিছানায় ভাগাভাগি করে অবস্থান, যতœকারীর নির্দেশ মান্য করার অভ্যাস, শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা ইত্যাদির ফলে শিশুদের মধ্যে খুব ছোট বয়স হতেই শৃঙ্খলাবোধ গড়ে ওঠে। যেসব শিশু বাড়িতে খাওয়া নিয়ে বিরক্ত করে, তারাও অন্যান্য শিশুর দেখাদেখি ঠিকমতো খায়। একটি শিশুর সঙ্গে আরেকটি শিশুর সখ্য গড়ে ওঠে। এতে শিশুর সামাজিকীকরণ দ্রুত হয়। তবে কোন অবস্থাতেই দিবাযতœ কেন্দ্রের পরিবেশ ও সেবার মান যাতে শিশুর অনুপযোগী হয়ে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করা জরুরী।
×