ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ী-বাঙালী দূরত্ব বাড়ছে

পার্বত্য এলাকায় উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

পার্বত্য এলাকায় উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তৎপর

ফিরোজ মান্না, বান্দরবান থেকে ॥ পাহাড়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হারাতে বসেছে। পাহাড়ী-বাঙালী উপজাতির মধ্যে দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েকদিন ধরে একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ী-বাঙালী উপজাতির মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পাহাড়ে এ নিয়ে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন কোন না কোন কর্মসূচী তারা পালন করে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে পাল্টাপাল্টি প্রচার-অপপ্রচার। উপজাতি নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোন মন্তব্য না করলেও পেছন থেকে দেয়া হচ্ছে ইন্ধন। এতে সন্ত্রাসী উগ্রপন্থীরা আরও শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। প্রশাসন তিন পার্বত্য জেলায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। পাহাড়ী-বাঙালী উপজাতিরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। দায়ী করা হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে। নানা দিক থেকেই পাহাড় এখন চরমভাবে উত্তপ্ত। উপজাতিরা অবরোধ, মানববন্ধন, গাড়ি ভাংচুর, হুমকি, পাল্টা হুমকিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। যে কোন সময় বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে। এজন্য তাদের বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। পার্বত্য এলাকা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে গত তিনদিন ধরে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে আতঙ্কের চিত্রটি উঠে এসেছে। তারা জানান, ১৯ এপ্রিল ইউপিডিএফের (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য রোমেল চাকমা ওরফে সুপেনের মৃত্যুর পর এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রশাসন বলছে, রোমেল ছিলেন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। মিয়ানমারের গভীর জঙ্গলে সে সশস্ত্র গ্রুপের কাছ থেকে নানা ধরনের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ২৩ জানুয়ারি বেতছড়ি এলাকায় নাশকতার ঘটনা ঘটায়। ইউপিডিএফ’র সক্রিয় সদস্য হয়ে সে অনেক অপারেশনে অংশ নেয়। এ ঘটনার পর যৌথবাহিনী তাকে ধরতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। গত ৫ এপ্রিল টিএ্যান্ডটি বাজারে অভিযানের সময় যৌথবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে রোমেল পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় একটি সিএনজির সঙ্গে ধাক্কা লেগে সে আহত হয়। এ অবস্থায় যৌথবাহিনী তাকে নানিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে গত ৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন ১৯ এপ্রিল সে মারা যায়। এরপরই তৎপর হয়ে ওঠে ইউপিডিএফ। নিজ দলের সদস্যর মৃত্যুকে পুঁজি করে সক্রিয় হয়ে ওঠে তারা। বিভিন্ন মাধ্যমে শুরু করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার। বিশেষ করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে দায়ী করে উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়ায়। তাদের এ ধরনের কার্যক্রম এখনও চলমান। এলাকাবাসী জানান, ইউপিডিএফ অপপ্রচার চালিয়ে বলছে, রোমেলকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে। মৃত্যুর পর তার লাশ পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমে এ খবর প্রচার করলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের স্থানীয় কয়েক বাসিন্দা বলেন, ইউপিডিএফ সম্পর্কে তাদের রয়েছে ভীতিকর অভিজ্ঞতা। এর আগেও কোন ইস্যু তৈরি করে নানা ধরনের নাশকতা চালিয়েছে। হত্যা ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। ইউপিডিএফের অপপ্রচার প্রসঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, লাশ পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার কোন ঘটনাই ঘটেনি। মানুষকে উস্কে দিয়ে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, ১৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোমেল মৃত্যুবরণ করে। এ সময় সে পুলিশের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিল। পরে ২১ এপ্রিল দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তার দেহ উপজাতি রীতি অনুযায়ী দাহ করা হয়েছে। দাহক্রিয়ার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজগর আলী, হেডম্যান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আত্মীয়-স্বজনরা। এছাড়া ভান্তে- নাইলদা গা তার দেহ দাহের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে রোমেলকে নির্যাতনের যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিষয়টি নিয়ে রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার সৈয়দ তারিকুল হাসান বলেন, আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে রোমেলের লাশ দাহ করা হয়েছে। এখানে লাশ পুড়িয়ে দেয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। এ নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যা বলা হচ্ছে তা কেবল অপপ্রচার মাত্র। ইউপিডিএফ কোন নিবন্ধিত সংগঠন নয়। সেহেতু তাদের সদস্যদের তালিকাও আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা জেনেছি, রোমেল চাকমা সংগঠনটির সশস্ত্র সদস্য ছিল। যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় পালাতে গিয়ে সে আহত হয়। পরে সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। একই প্রসঙ্গে রোমেলের লাশ দাহ কাজে যুক্ত ভান্তে- নাইলদা গা জানান, লাশ দাহ আমি করেছি। ধর্মীয় যেসব রীতিনীতি পালন করা প্রয়োজন তাও যথাযথভাবে করা হয়েছে। এদিকে রোমেল চাকমা কবে ইউপিডিএফের সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য হিসেবে যোগ দেয়, কোথায় কতদিন প্রশিক্ষণ নিয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানায় সম্প্রতি ওই গ্রুপ ছেড়ে আসা আরেক সশস্ত্র সদস্য। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহী ওই সদস্য গত ২৩ জানুয়ারির নাশকতার ঘটনায় জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেছে। সে জানায়, ওই নাশকতার ঘটনায় মোট ১৩ জন অংশ নেয়। এর মধ্যে ১১ জনের হাতেই হালকা ও ভারি অস্ত্র ছিল। রোমেল সম্পর্কে সে জানায়, তারা দুজন কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত দুর্গম পাহাড়ে কয়েক ধরনের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এদিকে রোমেল ইস্যুতে স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বাড়তি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। অন্যদিকে, রোমেলের মৃত্যুর কারণ জানতে মঙ্গলবার ঢাকা থেকে একটি মানবাধিকার সংগঠন রাঙ্গামাটি যান। কিন্তু তারা সেখানকার পরিস্থিতি ভাল না বুঝে আবার তারা চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। তারা রোমেলের মৃত্যুর বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক থেকে জানতে পারেন। এই সংগঠনের সঙ্গে যাওয়া নাট্যকার ও সম্পাদক মোঃ হাসান ফকরি টেলিফোনে জানান, আমরা রোমেলের মৃত্যুর কোন কারণ জানতে পারিনি। কেননা এলাকা অশান্ত ছিল। তাই আমরা রোমেলের বাড়িতে কলেজের অধ্যক্ষ পর্যন্ত যেতে পারিনি। আমাদের পরে ফিরে আসতে হয়েছে। আমাদের টিমে ছিলেন ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, এ্যাডভোকেট রাকবি পারভেজ, এ্যাডভোকেট মোঃ হাসান (আলফালা বাংলাদেশে এনজিওর প্রতিনিধি), বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি পারভেজ লেনিন।
×