ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভিক্ষুক থেকে সফল ব্যবসায়ী

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৬ মার্চ ২০১৭

ভিক্ষুক থেকে সফল ব্যবসায়ী

আনোয়ার রোজেন ॥ ওদের মধ্যে কেউ ছিলেন ভিক্ষুক। কেউ করতেন দিনমজুরের কাজ। কেউবা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ‘বরণ’ করেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধিতা। ওদের মধ্যে মিল ছিল একটাই। বছর দুয়েক আগেও হতদরিদ্র ছিলেন সবাই। মাত্র ১ লাখ টাকা বদলে দিয়েছে তাদের জীবন। নিজেদের উদ্যম আর প্রচেষ্টায় দারিদ্র্যের শিকল ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন তারা। ওরা প্রত্যেকে আজ দারিদ্র্যবিমোচনের ‘রোলমডেল’। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচীর আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় এনজিওর মাধ্যমে হতদরিদ্র ও ভিক্ষুকদের করা হচ্ছে স্বাবলম্বী। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়ন ঘুরে পাওয়া গেল দু’জনকে। আর পিরোজপুর সদর উপজেলার সিকদারমল্লিক ইউনিয়নের একজন নিজেই শুনালেন তার দারিদ্র্যজয়ের কাহিনী। ‘মুসলমান’ সেজে ভিক্ষা করতেন মনোরঞ্জন ॥ মনোরঞ্জন মঙ্গলের (৬৫) বাড়ি পিরোজপুর জেলার সদর উপজেলার সিকদারমল্লিক ইউনিয়নে। বছরখানেক আগেও ভিক্ষা করতেন মনোরঞ্জন। অভাবের তাড়নায় একমাত্র ছেলে পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছে বিশ বছর আগে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে এক দিনমজুরের সাথে। নিজের এবং স্ত্রীর দুবেলা আহার জোগাড় করতে হয়েছে ভিক্ষা করে। ‘হিন্দু’ বলে ভিক্ষার পরিমাণ কম হতো। সে জন্য মাঝে মাঝে ‘মুসলমান’ সেজে মাথায় টুপি পরে ভিক্ষা করতেন। এভাবে ভিক্ষা করে কেটেছে পনেরো বছর। তবে গত এক বছরে তার জীবন পাল্টে দিয়েছে পিকেএসএফ-এর ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচি। গত বছর ১ লাখ টাকা অনুদান পান মনোরঞ্জন মঙ্গল। তাকে কিনে দেয়া হয় একটি বাছুরসহ গাভী, বিশটি হাঁস এবং বিশটি মুরগি। তৈরি করে দেয়া হয় গোয়াল ঘর, হাঁস-মুরগির বাসস্থান এবং ঠিক করে দেয়া হয় তাঁর থাকার ঘরটি। এক বছরের ব্যবধানে তার এখন তিনটি গরু, যার মূল্য ১ লাখ টাকারও বেশি। তার রয়েছে আটচল্লিশটি মুরগি, পঁচিশটি হাঁস। সম্প্রতি একটি ছাগলও কিনেছেন তিনি। শুধুমাত্র ডিম বিক্রির আয় থেকেই সংসার চালাতে পারছেন। দিনে আয় করছেন ১৫০-২০০ টাকা। মনোরঞ্জন ও তার স্ত্রীর একদম সময় নেই কারও সাথে এক মিনিট কথা বলার। তারা সমাজে এখন খুবই ব্যস্ত মানুষ। মনোরঞ্জন এখন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ‘নেমন্ত্রণ’ খেতে যান! মনোরঞ্জন এখন আর ভিক্ষুক নন, সমাজে মর্যাদা সম্পন্ন একজন মানুষ। দিনমজুর ইসারুল এখন লাখপতি ॥ ২০০৭ সালে বিয়ের পরপরই ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে সংসারে থিতু হতে পারেননি গাজী ইসারুল আহম্মেদ (৩৫)। আইলা বিদ্ধস্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা থেকে খুলনায় এসে এক আত্মীয়ের জমিতে বসত গড়েন তিনি। কখনও কৃষিকাজ, কখনও রাজমিস্ত্রির সহকারী, কখনওবা ভ্যান চালিয়ে, দিনমজুরি করে সংসার চলছিল তার। কোয়েল পাখি চাষে স্বাবলম্বী এক যুবককে নিয়ে করা টেলিভিশন প্রতিবেদন দেখে আগ্রহী হন ইসারুল। প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোয়েল বাচ্চা নিয়ে খামার শুরু করেন ইসারুল। কিন্তু দুই-তিন বছরেও খামারটিকে বড় করতে পারছিলেন না। ২০১৩ সালে খুলনায় পিকেএসএফের সহযোগী সংস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা ঋণ ও কোয়েল চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ইসারুলের খামারে আজ ৫ হাজারেরও বেশি কোয়েল পাখি। প্রতিদিন ২ হাজারেরও বেশি ডিম দেয় পাখিগুলো। ওই ডিম দিয়েই ইনকিউবেটরের মাধ্যমে উৎপাদন হয় বাচ্চা। উৎপাদিত একদিনের বাচ্চা চলে যায় গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, পিরোজপুর, মোরেলগঞ্জ, নড়াইলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। এভাবেই দিনমজুর ইসারুল হয়ে ওঠেন সফল কোয়েল চাষী। সফলভাবে পরিশোধ করায় কয়েক দফায় মোট আড়াই লাখ টাকা ঋণও পেয়েছিলেন। তার নিট মাসিক আয় এখন ৪০-৪৫ হাজার টাকা। ইসারুলের স্বাবলম্বী হওয়ার চিত্র দেখে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের ফার্ম। ইসারুল স্বপ্ন দেখেন খুলনায় জমি কিনে বাড়ি করবেন, একমাত্র মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। প্রত্যয়ী এ যুবক জনকণ্ঠকে বলেন, আইলা আমার সব কেড়ে নিলেও মনোবল কেড়ে নিতে পারেনি। মানুষের শুধু ইচ্ছাশক্তি থাকলেই পথহারা থেকে নতুন পথের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। জলমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আশিকুজ্জামান বলেন, হতাশাগ্রস্ত যুবকদের জন্য ইসারুল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এলাকায় কোয়েল চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাকে দেখেই ইউনিয়নের অনেক যুবক কোয়েল চাষে আগ্রহী হয়েছে বলে শুনেছি। রিকশার মেকানিক থেকে ভিক্ষুক রবিউল ॥ জন্ম থেকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন ছিল রবিউল ইসলাম হাওলাদারের (৪৬)। বাবা ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি। রবিউলের যখন ২ বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে পড়ালেখা খুব বেশি করতে পারেননি। খুব অল্প বয়সে সংসারের দায়িত্ব বহন করতে হয়। তিনি পেশায় একজন সাইকেল-রিক্সার মিস্ত্রি ছিলেন। সাইকেল-রিক্সার মিস্ত্রির কাজ করে পরিবার পরিজন নিয়ে এক প্রকার সুখেই ছিলেন। ১০ বছর আগে হঠাৎ করে তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হন এবং ভুল চিকিৎসায় বরণ করেন পঙ্গুত্ব। পঙ্গুত্বের ধরনও একটু অন্যরকম। মেরুদ- সামনের দিকে বাঁকা হয়ে পুরা শরীর বাঁকা হয়ে যায়। ঘাড় এবং মাথা ডান-বাম কোন দিকে ঘোরে না। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না, ট্রাই সাইকেলে চলতে হয়। পঙ্গুত্বের কারণে নিজের চিকিৎসা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। স্ত্রী শাহিনুর বেগম মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাতে যে টাকা আয় হতো, তা দিয়ে কোনভাবেই সংসার চলত না। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে রবিউল ভিক্ষাবৃত্তিতে নামেন। রবিউল যে গ্যারেজে মিস্ত্রির কাজ করতেন সেই গ্যারেজ মালিক ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহারের জন্য ট্রাই সাইকেলটি কিনে দেন। দুই বছর আগে পুনর্বাসন কর্মসূচীর আওতায় তাকে ১ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। অনুদানের টাকায় স্থানীয় মাথাভাঙ্গা পার্কের পাশে একটি মুদি দোকান, একটি ছোট খাবার হোটেল, একটি চা-পানের দোকান এবং দোকান ঘরের নিচে জ্বালানি কাঠের দোকান শুরু করেন রবিউল। নিজের নামে বিদ্যুত অফিসে আবেদনের মাধ্যমে মিটারসহ একটি বিদ্যুত সংযোগও নেন। শুরুতে তেমন ভাল কেনাবেচা হতো না। এলাকার মানুষের সহমর্মিতায় ধীরে ধীরে কেনাবেচা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে দোকানে সব মিলিয়ে ১২০০-১৫০০ টাকা বিক্রি হয়। খরচা বাদে ১৫০ -১৬০ টাকা প্রতিদিন লাভ হয়। বর্তমান ব্যবসার পাশাপাশি বিগত দিনের লভ্যাংশের টাকা দিয়ে দোকানে একটি মোবাইল চার্জিং পয়েন্টের ব্যবসা খুলেছেন। দোকানের অদূরে খাস জমিতে বসবাসকারীদের বিদ্যুত না থাকায় তারা সকলে প্রতিদিন ২ টাকা করে দিয়ে মোবাইল দোকান থেকে চার্জ দিয়ে নিয়ে যায়। এখান থেকেও প্রতিদিন ২০-২৪ টাকা আয় হয়। এর পাশাপাশি বর্তমানে দোকানে একটি ক্যারামবোর্ড ক্রয় করে সেটি ভাড়ায় চালানো হচ্ছে। সেখান থেকেও প্রতিদিন ৫০- ৬০ টাকা আয় হয়। সম্প্রতি দোকানে ধানের কুড়ো (হাঁস-মুরগির খাবার) বিক্রি শুরু করেছেন। সেখান থেকেও প্রতিদিন ১৫-২০ টাকা আয় হয়। সবমিলিয়ে তার দৈনিক আয় ২৪০-২৬০ টাকা। ভিক্ষাবৃত্তির সময় বিভিন্ন সমিতিসহ মহাজনী ঋণ ছিল ২০ হাজার টাকা। ব্যবসা করে সংসারের সকল ব্যয় বহন করার পাশাপাশি ঋণের অর্থ পরিশোধ করেছেন। রবিউলের চার সন্তান। বড় ছেলে-মেয়ে দুইজন অভাবের কারণে অনেক আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তবে ছোট মেয়ে রহিমা (১০) এবং ছোট ছেলে রাসেল (৭) এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। রবিউল জনকণ্ঠকে বলেন, ভিক্ষুক বলে সমাজে আমার কোন সম্মান ছিল না। ছেলেমেয়েদের মুখে তিনবেলা খাবার দিতে পারতাম না। মাত্র ৫০০ টাকাও আমাকে কেউ ধার দিতে চাইত না। কারণ আমি পঙ্গু, আমার ফেরত দেয়ার সামর্থ্য ছিলো না। রবিউলের ভাষ্যমতে, তিনি এখন অনেক সুখে আছেন, শান্তিতে সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছেন। তাকে এখন আর কেউ ভিক্ষুক বলে না। স্ত্রীও আর ঝিয়ের কাজ করেন না। স্বামী-স্ত্রী মিলেই ব্যবসা পরিচালনা করেন। খুলনায় পিকেএসএফের ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় এনজিও উন্নয়ন। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরে এসে যারা নিজেদের উদ্যমে টেকসই কর্মসংস্থান ও আয়ের ব্যবস্থা করেন, আমরা তাদের ‘উদ্যমী সদস্য’ বলি। জলমা ইউনিয়নে উদ্যমী সদস্য সংখ্যা ১০ জন। এদের কেউই এখন আর ভিক্ষা করেন না। জানতে চাইলে পিকেএসএফ-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) ড. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, গত দুই বছরে তিন ধাপে সর্বমোট ৬২৫ জন ভিক্ষুককে এপর্যন্ত পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। যারা এখন আর ভিক্ষা করছেন না। মাত্র দু’জন এ প্রকল্প থেকে ছিটকে পড়লেও তারা আবার এ কর্মসূচীতে যুক্ত হচ্ছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আরও ২১২ জন ভিক্ষুকের পুনর্বাসন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি জানান, প্রত্যেক ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য পিকেএসএফ থেকে সর্বমোট ১ লাখ টাকার অনুদান বরাদ্দ দেয়া হয়। দেশে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে অনেক উদ্যোগ নেয়া হলেও সেগুলো টেকসই করা সম্ভব হয়নি। রাজধানী ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে প্রায় ৭ বছর আগে নেয়া সরকারের উদ্যোগটিও মুখথুবড়ে পড়েছে। বাজেট থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার অভাবে থমকে গেছে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের পুনর্বাসন কার্যক্রম। কিন্তু সমৃদ্ধি প্রকল্পের মাধ্যমে পিকেএসএফ এর এই কার্যক্রম সফল বলা যায়। কেননা এ প্রকল্পের ভিক্ষুকদের অনেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। অথবা সমাজ থেকে বিচ্যুত। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা একধরনের চ্যালেঞ্জ।
×