ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মার্টিন অধিকারী

শুভ বড়দিন ॥ মূল্যবোধ নিশ্চিত হলে বইবে শান্তির সুবাতাস

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

শুভ বড়দিন ॥ মূল্যবোধ নিশ্চিত হলে বইবে শান্তির সুবাতাস

আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের আলোকে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনের উৎসব ‘বড়দিন’ কেবল বিশেষ কোন দিন-তারিখের ব্যাপার নয়, তা হৃদয় ও মনের অবস্থার ব্যাপার। Benjamin Franklin-এর কথায়, good conscience is a continual Christmas..’ পাপের পংকিলতার অন্ধকারে নিপতিত মানুষের জন্য আশা ও আলোর জীবনের পথরূপে স্রষ্টা সৃষ্টিতে এলেন। খ্রিস্ট বলেছেন, ‘যাহারা আমাকে হে প্রভু, হে প্রভু বলে, তাহারা সকলেই যে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে এমন নয়, কিন্তু যে ব্যক্তি আমার স্বর্গস্ব পিতার ইচ্ছা পালন করে, সেই পাইবে’ (মথি ৭:২১)। ঈশ্বরের ইচ্ছা কি? বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়ম উভয় স্থানেই এ প্রশ্নের উত্তরে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ এই- আমরা যেন আমাদের জীবনের সমস্ত কিছুতেই ঈশ্বরকে সম্মান করি এবং অন্য মানুষকে আত্মতুল্য প্রেম করি। তার অর্থ এই যে, সম্পূর্ণ নম্রতায়, ভক্তিতে অন্তর্যামী যিনি সেই ঈশ্বরকে দেহ, আত্মা, মন ও প্রাণ দিয়ে এবং অন্য সকল মানুষের মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকারকে সম্মান করি। কিন্তু লোভ, হিংসা ও অশুভ প্রতিযোগিতার যূপকাষ্ঠে আমাদের সকল মূল্যবোধ আজ ভূলুণ্ঠিত। অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্যে আমাদের দিন আসে, দিন যায়। লোভ, হিংসা ও অন্যায়-অবিচার নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজ গোটা বিশ্বে তার মাত্রা যে বেড়েই চলছে! সবচেয়ে বড় শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার বিষয়ের একটি হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষার অপব্যাখ্যা ও তার অপব্যবহার, এমনকি নিষ্ঠুর জঙ্গীবাদ। মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় মনুষ্যত্ব। তা দিয়েই আজ মানুষের অন্য মানুষকে বিবেচনা করা জরুরী। দীন-দরিদ্র রাখালদের কাছে সেই প্রথম বড়দিনের রাতে যিশুর জন্মবারতা জানিয়ে স্বর্গদূতেরা এই আনন্দের গান শুনিয়েছিলেন, ‘উর্ধলোকে ঈশ্বরের মহিমা, পৃথিবীতে তাঁহার প্রীতিপাত্র মনুষ্যদের মধ্যে শান্তি’। দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবনযুদ্ধে সর্বস্বান্ত মানুষের জন্য সেদিন স্বর্গের দূতেরা ত্রাণকর্তা খ্রিস্টের শুভ জন্মবারতা শোনালেন। বাইবেলের শিক্ষায় সমস্ত সম্পদ ও সৃষ্টির স্রষ্টা ও একমাত্র সার্বভৌম মালিক ঈশ্বর, যিনি প্রেমময় ও ন্যায়বান। ‘পৃথিবী ও সমস্ত বস্তু সদাপ্রভুরই; জগত ও তন্নিবাসীগণ তাঁহার’ (গীতসংহিতা ২৪ : ১)। দু’হাজার ষোল বছর আগে যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময় স্বার্থপরতা ও অহঙ্কারের কারণে গোটা মানবজাতির যে অবস্থা ছিল তা আজও আছে। মানুষের এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ তার হৃদয়ের পরিবর্তন। সর্বত্রই অশান্তি, হিংসা ও মূল্যবোধের যেন অপ্রতিরোধ্য অবক্ষয়। মানুষে মানুষে, ধনী-নির্ধন, সবল-দুর্বল, ক্ষমতাহীন ও ক্ষমতাপন্ন মানুষে ভেদাভেদ দিনে দিনে আকারে প্রকারে বেড়ে চলছে। ঈশ্বর মানুষের সমূহ মুক্তির জন্য মানবরূপে খ্রিস্টের মধ্যে নিজের প্রেম, পবিত্রতা, ধার্মিকতা ও ন্যায্যতাকে প্রকাশ করলেন। মানুষের অবস্থাকে নিয়ে তিনি কেবল ভাবেননি, ঈশ্বরবিহীন মানুষের অবস্থাকে নিজে ভোগ করলেন কারণ তিনি তার বাস্তবতাকে পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করেছেন। প্রসঙ্গত এ জগতে যিশু খ্রিস্টের আগমনের মূল ঈশতাত্ত্বিক লক্ষ্য কি, আমাদের বুঝার দরকার আছে। কেন তিনি মানুষ হয়ে এলেন? এখানে খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্ববিদ্ হারম্যান বেভিংক এর এই উক্তিটি আসতে পারে, ‘সমস্ত সৃষ্টিই স্রষ্টা ঈশ্বরের এক প্রকাশ, তাঁর গুণাবলী ও সিদ্ধতার মুকুর; প্রত্যেক প্রাণী তার নিজ অবস্থানে ও তার নিজ উপায়ে ঐশ্বরিক অভিব্যক্তির একটা প্রতিফলন। কিন্তু সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে কেবল মানুষই ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি, তাঁর সর্বোচ্চ ও পরিপূর্ণ প্রকাশ এবং তাই সে সমস্ত সৃষ্টির মস্তক ও মুকুট।’ আদিপুস্তকে আমরা দেখি ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন। নতুন নিয়মে খ্রিস্টকে বলা হয়েছে ঈশ্বরের নিখুঁত প্রতিমূর্তি, তিনি অদৃশ্য ঈশ্বরের দৃশ্যমান প্রতিমূর্তি (কলসীয় ১ : ৫)। সে কারণে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি বলতে যা বুঝায় তা জানতে হলে আমাদের প্রথমে খ্রিস্টের দিকে তাকাতে হয়। মানুষের বুদ্ধি বা বিদ্যার বিচারে নয়, তার শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে তার প্রেমে। অন্য গুণাবলীর সঙ্গে প্রেমই হচ্ছে ঈশ্বরের নৈতিক গুণাবলীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমরা খ্রিস্টের মধ্যে ঈশ্বরের প্রেমের চূড়ান্ত প্রকাশ দেখতে পাই। আদিপুস্তকে আমরা জানতে পারি, ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রেমরূপী প্রতিমূর্তিতে নির্মাণ করেছেন। ঈশ্বরের অন্যান্য নৈতিক গুণাবলী, যেমন- পবিত্রতা, বিবেক ও বুুদ্ধি, যুক্তি, ন্যায্যতা ইত্যাদির চেয়ে সবচেয়ে বড় হলো ‘প্রেম’। এই নৈতিক গুণাবলী হেতু মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। মানুষ এক আত্মিক প্রাণী। মানুষে মানুষে যদি ন্যায্যতা ও শান্তি থাকে তাহলেই স্বর্গে ঈশ্বরের গৌরব ও মহিমা হবে। অশান্ত এ পৃথিবীর মানুষ যদি যিশু খ্রিস্টের নিঃস্বার্থ প্রেম এবং জীবন সম্পর্কে তাঁর পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলতে চেষ্টা করত তাহলে পৃথিবীর অবস্থা কতই না সুন্দর ও শান্তিময় হতো! জগত আজ কেবল প্রেমহীন ভালবাসার ভাল ভাল কথায় ভরে গেছে, নিষ্ক্রিয় উৎকণ্ঠার ভারে মানুষ ন্যুয়ে পড়ছে। কর্তব্য-জ্ঞানহীন উপদেশের বোঝা আজ আর নয়। সর্বস্তরে আজ চাই কথা ও কাজের মিল। বড়দিন এসেছে আমাদের এ আহ্বান জানাতে, যেন আমরা একে অন্যের সঙ্গে শান্তি ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্য সচেষ্ট হই, হই সক্রিয়। আমাদের এই চেতনা সকলের মধ্যেই জাগরিত হোক, হোক তা কাজে পরিণত। সনাতন ঈশ্বরের চিন্তা ও বাক্য যেমন খ্রিস্টেতে মানবাকারে মূর্ত হয়েছে, তেমনিই হোক আমাদের সকল সুন্দর কথা ও চিন্তা জীবনে প্রকাশিত। আজ সমাজে দুষ্টতা, ছলনা ও ভ-ামি সীমাহীন। যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল আমাদের বড় এক বৈশিষ্ট্য; এখনও তা সাধারণ অর্থে বিরাজমান। কিন্তু কিছু মানুষ ও তাদের উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গী তৎপরতা সমাজের মধ্যে একটা ত্রাস ও অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে। সংকীর্ণ স্বার্থের বশবর্তী হচ্ছে অনেকে। সত্য পথ থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে, ধর্মের নামে মানুষকে লাঞ্ছিত, এমনকি সংহার করাকে গর্বের বিষয় বোধ করছে। বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘিষ্ঠ ও বিদেশীদের ওপরে তারা চড়াও হয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে এবং কাউকে বা হত্যার হুমকি দিয়ে চলেছে। এ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আজকে পৃথিবীর যে অবস্থা তাতে একটি বড় প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে উঠে কিভাবে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যায় সবাই মিলে একসঙ্গে তার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত সমস্যা, পরিবেশ-প্রকৃতি দূষণ, উগ্র বস্তুবাদ ও ভোগবাদ, বিশ্বব্যাপী ধনী-দরিদ্রের ভয়াবহ বৈষম্য, অশান্তি, শরণার্থী সমস্যা, অপুষ্টি, নারী ও শিশুপাচার, যৌনব্যবসা, শিশুশ্রম, নারীর অমর্যাদা, মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা ইত্যকার শত রকমের কঠিন সমস্যায় জর্জরিত মানব সমাজ। এখানে বলা দরকার যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া বাকি সব সমস্যার কারণ মানুষের লোভ ও অহঙ্কার, আর এসবের সমাধানও মানুষের হাতে আছে। খ্রিস্টের শিক্ষা, ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়। বড়দিনে আমাদের কাছে খ্রিস্টের আহ্বান এই, যেন আমরা ঈশ্বরের পবিত্রতা, প্রেম ও ধার্মিকতাকে বুঝতে চেষ্টা করি এবং ঐশ্বরিক মূল্যবোধে চলার জন্য যথাসাধ্য করি। ঈশ্বরকে সম্মান দেখানোর সর্বোত্তম উপায় মানুষকে, তার অধিকারকে সম্মান করা। আমি যদি কোন মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন করতে চাই, তাহলে প্রথমে তাকে ভালবাসতে হবে। এ সত্য ঈশ^র খ্রিস্টের মধ্যদিয়ে চূড়ান্তভাবে দেখিয়েছেন। আমাদের সামগ্রিক মঙ্গল ও কুশলের জন্য প্রেমের অবতার খ্রিস্ট মানবদেহে এ জগতে এসে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর স¦র্গীয় জীবন। ত্যাগ ও প্রেমের গুরু অমৃত পুরুষ খ্রিস্টের জীবন আমাদের জীবনকে আলোকিত করুক, করুক দীক্ষিত! লেখক : খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক
×