ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর বিমানে ত্রুটি ॥ তদন্ত রিপোর্ট পেশ

আরও তিন প্রকৌশলী সাসপেন্ড

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

আরও তিন প্রকৌশলী সাসপেন্ড

আজাদ সুলায়মান ॥ ঢাকা থেকে বুদাপেস্টগামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় দেবেশ চৌধুরী, এস. এ. সিদ্দিক ও বিল্লাল হোসেন নামে আরও তিন প্রধান প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে তিন বিভাগীয় প্রধানসহ মোট নয় জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে, এটা মুনষ্যসৃষ্ট ত্রুটি। কিন্তু এই মনুষ্যসৃষ্ট কি নাশকতা, নাকি অদক্ষতা সে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি। এদিকে এ তদন্ত প্রতিবেদনে ওই ঘটনার জন্য শুধু প্রকৌশলীদেরই দায়ী করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছে পাইলটদের। তদন্ত কমিটির প্রধান একজন পাইলট হওয়ায় এতে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিমান প্রকৌশল বিভাগ। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জনকণ্ঠকে বলেন, বিমান প্রতিবেদন দাখিল করলেও আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি। এতে কি আছে তাও দেখিনি। শুনেছি আরও তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে এ রিপোর্টই শেষ নয়, মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিতে কি পাওয়া যায় সেটার ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগামী দু’একদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। বিমানের জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ জানান, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ৩০ নবেম্বর ৬ জনকে এবং ১২ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রতিবেদন ভিত্তিতে আরও ৩ বিভাগীয় প্রধানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে চীফ ইঞ্জিনিয়ার (প্রডাকশন) দেবেশ চৌধুরী, চীফ ইঞ্জিনিয়ার (পরিদর্শন ও মান নিশ্চিতকরণ) এস. এ. সিদ্দিক ও প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (মেনটেন্যান্স এ্যান্ড সিস্টেম) বিল্লাল হোসেন। এর আগে বরখাস্ত করা হয় বিমানের প্রকৌশল শাখার ইঞ্জিনিয়ার এস এম রোকনুজ্জামান, সামিউল হক, লুৎফর রহমান, মিলন চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন ও টেকনিশিয়ান সিদ্দিকুর রহমানকে। গত সোমবার বিমানের ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক আহমেদের কাছে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তিন প্রধান প্রকৌশলীকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আরও কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। তবে এ ঘটনায় পাইলটদের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠলেও তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়নি। উল্টো বুদাপেস্ট যাবার পথে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ার পর তুর্কেমেনিস্তানে নিরাপদে জরুরী অবতরণ করার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। অথচ এ সম্পর্কে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঢাকা থেকে বুদাপেস্টগামী প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের চূড়ান্ত প্রতিবেদনকে সম্পূর্ণ বলা যাবে না ও গ্রহণযোগ্য বলে অ্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ কম। কেননা এতে অনেক কিছুই ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। যান্ত্রিক ত্রুটির দায়ভার একতরফাভাবে শুধু গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর চাপানো হয়েছে। ভিভিআইপি ফ্লাইটের দায়ভার শুধু গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের দু’ঘণ্টা পর ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে লাহোরের আকাশসীমায় ওয়ের প্রেসার কমে যাওয়ার মতো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ার পর ককপিট ক্রুরা যে ভুল করেছে তা তো লগ বইয়েই উল্লেখ করা আছে। ফ্লাইট ডাটা ম্যানেজমেন্ট (এফডিএম)-এ এখনও তার প্রমাণ রয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই সেটা কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ককপিটে কি ঘটেছিল, জরুরী অবতরণের সময় সেখানে ঠিকমতো এসওপি ও চেক লিস্ট মানা হয়েছিল কিনা সেগুলো তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করাটা আবশ্যক। কেননা ওই ফ্লাইটে ভিভিআইপি কভারেজে ছিলেন ক্যাপ্টেন ইসমাইল, কো পাইলট আমিনুল হক আরও দুজন ফার্স্ট অফিসারসহ বিমানের ডিএফও ক্যাপ্টেন জামিল। এ সম্পর্কে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তুর্কেমেনিস্তানে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে জরুরী অবতরণের সময় কিছু ঘটেনি বলে এটাকে ‘নিরাপদ অবতরণ’ বলার কোন সুযোগ নেই। জরুরী অবতরণের আগে ওই ফ্লাইটে যা ঘটেছে তা আরও ভয়াবহ। ডিএফও জামিল ছাড়াও আরও চারজন পাইলট সেদিনের রাঙ্গাপ্রভাতের ছিলেন। অথচ তাদের উপস্থিতিতে জরুরী অবতরণের আগে যখন যা করা বাধ্যতামূলক ছিল তার কিছুই করা হয়নি। যেমন বোয়িং ৭৭৭ এ যান্ত্রিক ত্রুটি বা এ ধরনের অয়েল প্রেসার জটিলতা দেখা দিলে কি করতে হবে তা সামনের মনিটরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেসে ওঠে। ডিজিটালাইজ মনিটরের একের পর এক আবশ্যক করণীয় ভেসে ওঠে যা বলা হয়ে থাকে চেক লিস্ট। এভিয়েশন রুলস অনুযায়ী এ চেক লিস্ট লঙ্ঘন করার কোন সুযোগ নেই। তুর্কেমেনিস্তানের জরুরী অবতরণের আগে ওই ফ্লাইটে চেক লিস্ট অমান্য করে ক্যাপ্টেন নিজের খেয়াল খুশি মতো অবতরণ করেছেন। যা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল। কারণ চেক লিস্ট অনুযায়ী ওয়েল লাইন বন্ধ করা, ইঞ্জিন শাট ডাউন করা, লিবারি টানা ও ট্রান্সপন্ডার অন করার মতো অত্যাবশ্যকীয় কাজ কোনটাই না করে অবতরণ করা হয় রাঙ্গাপ্রভাত। এভাবে অবতরণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এখন কিছু ঘটেনি বলেই নিরাপদ অবতরণ অ্যাখ্যা দিয়ে ককপিটের সবাইকে দায়মুক্ত করা হবেÑ তেমন লক্ষণই ফুটে উঠেছে বিমানের চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে। এ সম্পর্কে বিমানের অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, চার সদস্যের ওই তদন্ত কমিটিতে ছিলেন বিমানের চীফ অব টেকনিক্যাল ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরী চীফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন সোয়েব চৌধুরী, ডেপুটি চীফ অব ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হানিফ ও ম্যানেজার (কোয়ালিটি এ্যাসুরেন্স) নিরঞ্জন রায়। এদের প্রথম দুজন ক্যাপ্টেন হলেন ডিএফও ক্যাপ্টেন জামিলের অধীনস্থ কর্মকর্তা। এছাড়া ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ইসমাইল ও আমিনুলের সঙ্গে রয়েছে তাদের সখ্যতা। সঙ্গত কারণেই এ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে পাইলটদের ভুল ত্রুটি ও অদক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন করা দূরে থাক, উল্টো তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২৭ নবেম্বর হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং ৭৭৭ বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাতে জরুরী অবতরণ করে। ত্রুটি মেরামত করে সেখানে চার ঘণ্টা অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি পর ওই উড়োজাহাজেই প্রধানমন্ত্রী সফরসঙ্গীরা বুদাপেস্টে পৌঁছান। প্রধানমন্ত্রী প্রথমে এটাকে নিয়তি বলে উল্লেখ করলেও পরে বলেছেন, মনুষ্যসৃষ্টি যান্ত্রিক ত্রুটি। তারপর এ ঘটনার তদন্তে নতুন মাত্রা যোগ হয়। মন্ত্রণালয়ের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এনএসআইয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসানকে। একই ঘটনা সিভিল এভিয়েশনও নিজস্ব উদ্যোগে আরও একটি তদন্ত কমিটির কাজ চলছে। এই তিনটে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেই প্রকৃত ঘটনা ওঠে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
×