ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিনেমা দেখার দিন ॥ হারিয়ে গেছে

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

সিনেমা দেখার দিন ॥ হারিয়ে গেছে

হলে গিয়ে সিনেমা দেখার দিন আজ কত দূরে। প্রতিটি পরিবারে ‘সিনেমা দেখা’ কাছের অতীতের স্মৃতিময় উপাখ্যান। একটা সময় সিনেমা দেখাকে কেউ মন্দ চোখে দেখেনি। সিনেমা ছিল দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিলে-মিশে থাকা সামাজিক বিনোদনের বড় অধ্যায়। আগে যে ছবি নির্মিত হতো, তার মধ্যে এমন তিনটি উপাদান ছিল যা আমাদের সমাজ জীবনকে সঠিক পথ ধরে গড়ে নিতে সহযোগিতা করেছে। এই তিন উপাদান হলো- বিনোদন, শিক্ষা ও তথ্য। সুস্থ বিনোদনের জন্য প্রণয় বা প্রেম প্রতিটি ছবিতেই ছিল। তবে তা ছিল সামাজিক চেতনার অংশ। এই মিষ্টি প্রেম কখনও সমাজকে কলুষিত করেনি। মানব জীবনের চিরকালীন সত্তা রোমান্টিসিজমকে মধুময় অধ্যায়ে এগিয়ে নিতে সহায়তা দিয়েছে। সমাজের সকল কলুষতা দূর করে সমাজকে সুন্দর পথ ধরে এগিয়ে নেয়ার মেসেজ থেকেছে। যে কারণে কোন পরিবারই সিনেমা দেখাকে কখনও নিরুৎসাহিত করেনি বরং উল্টো মা-বাবা ভাইবোনসহ পরিবারের সবাই একসঙ্গে হলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ করেছে। আগে এই সিনেমা দেখাকে কখনও বলা হতো ‘বই’ দেখা। মনে করা হতো সিনেমা একটা বই। পরিবারগুলোতে বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এমনও হয়েছে কোন হলে গিয়ে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পর সেই ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। ছবিতে কি বিষয় ছিল, কেন ছিল তা নিয়ে মতামত। সেদিনের সেই সিনেমা এমনভাবে নির্মিত হতো, যেন পরিবারের সবাই একসঙ্গে হলে গিয়ে দেখতে পারে। আজ যারা মধ্য বয়সী কিংবা প্রবীণ তাদের কাছে সিনেমা শব্দটি নস্টালজিক করে দেয়। চল্লিশের দশকে নির্বাক ছবি সবাক হয়ে প্রবেশ করে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক পেরিয়ে সত্তর দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত সিনেমা মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনের অংশ মনে করা হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে সিনেমা দেখার মধুময় কাল ছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশক শেষ হয়ে সত্তর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত। গত শতকের ষাটের দশকে ১৯৬৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ দেশে ভারতীয় হিন্দী ও বাংলা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এরপর শুধু পাকিস্তানী উর্দু ও ঢাকায় নির্মিত ছবি প্রদর্শিত হয়। একটা সময় ঢাকায় বাংলা ছবির পাশাপাশি উর্দু ছবি নির্মিত হয়েছে। যেমন তালাশ, চান্দা, পায়সে, সংগম, বাহানা, ভাইয়া, চকোরি, ছোট সাহেব, আনাড়ি ইত্যাদি। এসব ছবিতে অভিনয় করেছেন রহমান, শবনম, সুলতানা জামান, গোলাম মোস্তফা, ফ্যাটি মোহসিন, খলিল, শাবানা, নাদিম, হারুন, আজিম, সুভাষ দত্ত, রেশমা, নাসিমা খান প্রমুখ। ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী ছবি ও পাকিস্তানী উর্দু ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে ঢাকায় যে ছবি নির্মিত হয়েছে তা দেশ বিদেশ থেকে পুরস্কার এনেছে। ১৯৬৪ সালে যখন এ দেশে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী এবং পাকিস্তানের উর্দু ছবির জোয়ার, তখন সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং ছবি প্রতিটি সিনেমা হলে দুই/আড়াই মাস একটানা চলেছে। ইতিহাস ভিত্তিক ছবি নবাব সিরাজউদ্দৌলা দেখার জন্য সিনেমা হল থেকে দর্শক নামনো যায়নি। পৌরাণিক উপাখ্যানের ছবি রূপবান, বেহুলা, সাত ভাই চস্পা ছবির দর্শক ছিলেন সেদিনের প্রবীণরা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আলোর মিছিল, আবার তোরা মানুষ হ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরেছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দেশের জেলা ও মহকুমায়, রেলওয়ের বড় জংশনে এবং উল্লেখযোগ্য স্থানে (যেমন সৈয়দপুর) সিনেমা হল ছিল একটি বা দুটি করে। তখন সিনেমা হলে প্রতিদিন শো হতো দু’টি। ফার্স্ট শো সন্ধ্যা ৬টায় সেকেন্ড শো রাত ন’টায়। নামী-দামী পরিচালক এবং হার্ট থ্রব নায়ক নায়িকার ছবি এলে প্রথম তিন দিন বিকেল ৩টায় ম্যাটিনি শো চলেছে। সেদিনের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণরা প্রথম তিন দিন ম্যাটিনি শো দেখার সুযোগ নিয়েছে। এমন সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে মা-বাবাকে বলে ফার্স্ট শো দেখার অনুমতি মিলেছে। এই অনুমতি পেতে কত যে তালবাহানা ও কসরত করতে হয়েছে! সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল মা-বাবা অনুমতি দেয়ার পর বাবা ও তার বন্ধুরা সমবেত হতো সেই ছবি দেখার জন্য। অবস্থা এমনও হয়েছে ছেলে সিনেমা হলে ঢুকে দেখে তার বাপ-চাচা-খালু কোন না কোন আসনে বসে আছেন। সিনেমা দেখার বড় সুযোগ ও আকর্ষণ ছিল বাড়িতে অতিথি কুটুম্ব বেড়াতে এলে। কুটুম্ব যে ক’দিন থাক, এর মধ্যে সিনেমা দেখা ছিল ম্যান্ডেটরি। বাড়িতে কুটুম্ব আসবে, মেহমান আসবে সিনেমা দেখা হবে না, তা কি হয়! কখনও শুধু এক ছবি নয় শহরের দুই বা তিন সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা চাই। ভাল ছবি হলে তো কথাই নেই। ভাল ছবি বলতে নাম করা পরিচালক ও নামী অভিনেতা অভিনেত্রীর ছবি। যেমন ভারতীয় বাংলা ছবি সুচিত্রা উত্তম জুটি থাকলে কোন দেখাদেখি নেই। কোনভাবেই যেন এ ছবি মিস না হয়। সেদিনের ভারতীয় অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি স্যানাল, বিকাশ রায়, কমল মিত্র ছবিতে থাকলে ধরে নেয়া হতো হিট ছবি। তেমনই হিন্দী ছবির দিলীপ কুমার, দেবানন্দ, রাজকাপুর, পৃথি¦রাজ কাপুর, মধুবালা, বৈজয়ন্তীমালা, মিনা কুমারী থাকলে সেই ছবি দেখা চাই-ই। ঢাকার ছবিতে ষাটের দশকের মধ্যভাগে রহমান-শবনম এবং মধ্যভাগের পর আজিম-সুজাতা, রাজ্জাক, সোহেল রানা, কবরী, সুচন্দা, উজ্জ্বল, ফারুক, জাফর ইকবাল, ববিতা, কাজী খালেক, খলিল, গোলাম মোস্তফা, ফতেহ লোহানী, আনোয়ার হোসেন, খান আতাউর রহমান ও শর্মিলীর ছবি দর্শক লুফে নিয়েছে। সে সময় পরিচালকের নাম দেখে দর্শক গেছে হলে। যেমন জহির রায়হান, এহতেশাম, মুস্তাফিজ খান, আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, কাজী জহির প্রমুখ। সিনেমা দেখার নেশা যাদের ছিল তারা কখনই অন্য পথে যায়নি। প্রেম করলে তার মধ্যে ছিল আর্ট। সেদিনের ছবি এমন শিক্ষা দিত, যাতে কেউ বিপথে না যায়। সামজিক ও রোমান্টিক ছবি ছিল হৃদয় ছোঁয়া। সেদিনের সিনেমা হলে ছবি প্রদর্শিত হতো বড় প্রজেক্টের ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মে। নিচ তলায় রিয়ার স্টল, মিডল স্টল, ফ্রন্ট স্টল দোতলায় ড্রেস সার্কেল। তিন তলায় প্রজেক্টর। ছবি নির্মাণের পর ১২, ১৪ অথবা ১৬টি রিলে সিনেমা হলে পাঠানো হতো। প্রতি রিলে আটশ’ থেকে এক হাজার ফুট মুভি চিত্র থাকত। পর্দায় সেন্সর সার্টিফিকেট প্রদর্শনের সময় দর্শকরা দেখে নিত কত রিলের ছবি। কোন কারণে রিল ছিঁড়ে গেলে তা জোড়া দিতে এক ধরনের সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে। অপারেটর কয়েকটি রিল একত্রিত করে পেঁচিয়ে প্রজেক্টরে জুড়ে কার্বন রশ্মিতে প্রদর্শন করত। আরেকটি প্রজেক্টরে পরবর্তী রিল এঁটে রাখত, একটি শেষ হলে আরেকটি চালু হতো। রিল প্রদর্শনের পর ফের পেঁচিয়ে পূর্বাবস্থায় নিয়ে পরবর্তী শোর জন্য তৈরি করা হতো। সিনেমা হল এলাকায় পানের দোকানে সিনেমার গানের চটি বই বিক্রি হতো। সিনেমা দেখার পর এই বই কিনে গান মুখস্থ করত সেদিনের অনেক তরুণ। সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার সে দিন হারিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে হলে ছবি দেখার কথা এখন ভাবতেও পারে না কেউ। হলের পরিবেশও ভাল নয়। পরিবার নিয়ে দেখার ছবি বলতে যা বোঝায় তাও বেশি নেই। এর মধ্যে হাতেগোনা যে দু’একটি ছবি নির্মিত হচ্ছে তা দেখার জন্য সিনেমা হলের পরিবেশ যে পরিচ্ছন্ন থাকার কথা, তা নেই। বড় শহরের বেশিরভাগ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে সুপার মার্কেট হয়েছে। হালে ঢাকার যে মারদাঙ্গা ছবিগুলো হচ্ছে তার চেয়ে উন্নত ছবি ঘরে বসেই দেখা যায় টিভি চ্যানেলে, ইন্টারনেটে। তারপরও বড় পর্দায় ছবি দেখার মজাই আলাদা। সেই ছবি কি আজ নির্মিত হচ্ছে! সেদিনের মতো সেøা ছবি আজ চলবে না এটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক ফার্স্ট ছবি হলেও তাতে যদি সুন্দর পরিপাটি গল্প না থাকে, তাহলে সে ছবি কেন দেখতে যাবে দর্শক! ঢাকার সিনেপ্লেক্সগুলো দেশী-বিদেশী ভাল ছবি এনে দর্শকদের সিনেমা হলমুখী করার চেষ্টা করছে। ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলো এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছেনি। দু‘ একটি জেলায় হাতেগোনা সিনেপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। উত্তরের উন্নত জেলা বগুড়ার মধুবন সিনেমা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগামী বছর তারা পুরনো সিনেমা হলকে আধুনিকায়ন করে সিনেপ্লেক্স বানাবে। এভাবে সিনেমা হল দর্শক টানার চেষ্টা হচ্ছে। তবে কথা একটাই পরিচ্ছন্ন সুস্থ বিনোদনের ছবি নাহলে কে যাবে সিনেপ্লেক্সে? সিনেমা হলে ছবি দেখার সেই মধুময় দিন অধরাই থেকে যাচ্ছে...। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×