ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চামেলী রায়ের অসমাপ্ত

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

চামেলী রায়ের অসমাপ্ত

বইটির লেখক আমার একেবারে অচেনা নন। দর্শন পড়তেন। ফুটফুটে মেয়ে। এখন এক পরিসংখ্যানের অধ্যাপকের সহধর্মিণী। কাজের ডাকে স্বামীর সপরিবারে নানা দেশে ঘোরা। আফ্রিকাতেও। সেই সূত্রে লেখকেরও পরিচয় হয় কত রকম মানুষের সঙ্গে। কত মানুষীর সঙ্গে। তাঁর দার্শনিক বোধে তারা দোলা দেয়। মৌল মানবিক প্রশ্ন সব মাথায় জাগে। উপন্যাসে তাদের ছাপ পড়ে। তবে একটা গুরুতর বাধা ঠেলে তাঁর লেখা। দৃষ্টিশক্তি তাঁর ক্রমহ্রাসমান। দেশে-বিদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেখিয়েছেন। আশার কথা কেউ শোনাননি। সামনে নিরুপায় অন্ধকার। তার আতঙ্কও বোধহয় অবচেতনে লেখায় মেশে। ভাষার শৃঙ্খলা একটু-আধটু টাল খায়। দু-একটা অযাচিত শব্দ হুড়মুড়িয়ে আসে। অনেক কিছু যেন এক সঙ্গে বলে ফেলার তাড়া। তাতে সাহিত্যের ম-নকলায় গতি ও স্থিতির সামঞ্জস্য হঠাৎ হঠাৎ খুব কম হলেও মাঝে মাঝে অল্প-স্বল্প কেটে কেটে যায়। লেখকের স্বাভাবিক ক্ষমতা তাকে অতিক্রম করে অবশ্যই। কিন্তু তা থাকে। উপন্যাস যদিও আমাদের আকর্ষণ হারায় না। কাহিনীর প্রেক্ষাপট লোহিত সাগরের পারে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার নবীন রাষ্ট্র ইরিত্রিয়ায় প্রধান শহর আসমারা। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে এর বিস্তার। মূল জটিলতার উৎসও সেখানে। তবে লেখক একই সঙ্গে কল্প-বিজ্ঞান, মানবিক বোধ, আশা-নিরাশা, বিবেকের তাড়না, আন্তর্জাতিকতা, সব কিছু এক জায়গায় মিশিয়েছেন। বইটি ক্ষীণাঙ্গীই। তবু তালগোল পাকিয়ে যায়নি। এখানে লেখকের স্বাভাবিক মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে। আমরা দেখি সহজলভ্য কৃষাঙ্গীর পিতৃপরিচয়হীন শ্বেত সন্তানকে মানুষ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানী। পাশাপাশি তিনি রচনা করেন বিকল্প ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটির জগত। এক অসামান্য যান্ত্রিক নারীকে তিনি মানবিক বৃত্তি আরোপ করেন, যদিও সে মানবী হয় না। ছেলেটি আবার আসমারায় আসে তার মাতৃপরিচয় জানার কৌতূহলে এবং আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে সেও ইরিত্রিয়ায় আর এক মনোলোভা নারীর কৌমার্য হরণ করে তাকে সন্তানবতী করে। অন্যদিকে যন্ত্রমানবীর আকর্ষণ। কী করবে সে ভেবে পায় না। উত্তর অসমাপ্ত রেখে উপন্যাসের যবনিকা পড়ে। আমার মনে হয়েছে, গড়পড়তা বাংলা কথাসাহিত্যের ভিড়ে অসমাপ্ত হারিয়ে যাবে না। তবে এর আরও সম্ভাবনা ছিল। লেখক যে তাঁর পূর্ণ প্রতিভার সুস্থির প্রয়োগ ঘটাতে পারেননি, এ জন্য আক্ষেপ হয়। আর একটা কথা এখানে না বলা নয়। চামেলী রায় বা তাঁর মতো প্রতিশ্রুতিশীল অনেক লেখক কিন্তু যথোচিত সংযোগের অভাবে অকালে হারিয়ে যান। কেউ কেউ প্রতারণার ফাঁদেও পড়েন। আমাদের প্রকাশনা জগত কি বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন?
×