ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পানামা কেন গোপন সম্পদের স্বর্গরাজ্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৩১ আগস্ট ২০১৬

পানামা কেন গোপন সম্পদের স্বর্গরাজ্য

আজ থেকে ২৬ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র পানামায় হামলা চালিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল সে দেশের প্রেসিডেন্ট নরিয়েগাকে উৎখাত করা। পানামা তখন মাদক চোরাকারবারের কেন্দ্র হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। অপরাধের মাত্রা সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছেছিল। দেশটা পরে সুনাম ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করে। তথাপি পানামা অর্থ সম্পদ গচ্ছিত রাখার অন্যতম অফশোর স্বর্গরাজ্য হিসেবে থেকে যায়। যারা কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত ছিল তাঁরা অপশোর ব্যাংকিংয়ের গোপনীয়তা থেকে লাভবান হয়েছিল। তার পরও পানামার উন্নয়ন ঘটে চলেছিল। ভৌগোলিক অবস্থানটাই দেশটাকে আমেরিকানদের কাছে লজিস্টিক্স কেন্দ্র হিসেবে অসাধারণ উপযোগী করে তুলেছিল। এর এয়ারলাইন কোপা পানামা সিটিতে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলের একটা প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল। পানামা খালের সম্প্রসারণ গত ২৬ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেটাও আরেক মাইলফলকে পরিণত হয়েছে যদিও এর নিরাপত্তা, নির্মাণ কাজের গুণগত মান এবং অর্থনৈতিক সম্ভবসাধ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পানামাকে কর ফাঁকি ও মানিলন্ডারিংয়ের কেন্দ্র হতে হয়নি এবং সৎ মানুষরা তাই জানত। সে জন্যই পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে দেশটির আর্থিক ও আইন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা মূল্যায়ন করা এবং তা জোরদার করার উপায় সুপারিশ করার জন্য পানামা সরকার আমাদের একটা বিশেষজ্ঞ কমিটিতে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানালে আমরা আনন্দ-উত্তেজনা বোধ করেছিলাম। (স্টিগলিজকে কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল) আমাদের কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবত পানামা যা করত সেটা গোপনীয়তার এ জাতীয় অন্যান্য কেন্দ্রের জন্য একটা মডেল হিসেবে কাজ করত। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক পানামা সিটিতে কমিটির উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সরকারের এই অঙ্গীকারই ফুটে উঠেছিল বলে মনে হয়েছিল। তবে সেখান থেকে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। সরকার ও কমিটির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গের প্রেরিত পত্রাবলী থেকে বোঝা যায় যে রিপোর্টের পূর্ণ স্বচ্ছতার প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। তাই গত জুন মাসে নিউইয়র্ক সিটিতে অনুষ্ঠিত কমিটির প্রথম পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে আমরা দাবি করেছিলাম যে রিপোর্টে যা-ই পাওয়া যাক না কেন রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে সরকারকে অঙ্গীকার ঘোষণা করতে হবে। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের দাবির জবাব দিতে সরকারকে সময় নেয়ার দরকার হতে পারে। কিন্তু হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ গড়িয়ে গেল, কোন জবাব এলো না; কিন্তু এরপর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম যখন সরকার এ ধরনের কোন আশ্বাস প্রদানে অস্বীকৃতি জানাল এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল যে, যে ডিক্রিবলে কমিটি গঠিত হয়েছে তার শর্ত অনুযায়ী রিপোর্টের ফলাফল প্রকাশ করার দায়-দায়িত্ব একমাত্র সরকারের সম্ভবত এর দ্বারা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এ কথাগুলোর কি অর্থ। ...সরকার যখন স্বচ্ছতার আশ্বাস দিতে পারল না তখন পদত্যাগ করা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ ছিল না। আমরা শুধু জল্পনা করতে পারি কি ঘটেছিল। ব্যাপারটা কি বরাবরই ছিল একটা পাবলিক রিলেশন স্ট্যান্ট এবং তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের অঙ্গীকারকে হিসেবে নিতে ভুল করেছিলেন? গোপনীয়তার পক্ষের শক্তিগুলো কি শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হয়েছিল? কিসের ভয় পেয়েছিল ওরা? আমাদের প্রাথমিক বৈঠকে কর বিষয়ক তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানের ব্যাপারে কমিটির পানামীয় কিছু কিছু সদস্যের তরফ থেকে বিরোধিতা এসেছিল। কিন্তু বৈঠক পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সরকার এ ব্যাপারে সম্মত হয়। পানামা অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আইনে বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছে। সম্ভবত সরকার এ ভেবে উদ্বিগ্ন ছিল যে কথা ও কাজের মধ্যে, আইন ও তার প্রয়োগের মধ্যে বিরাট ব্যবধান আমাদের চোখে ধরা পড়বে। সরকার কি ভেবেছিল যে পানামার কর মুক্ত অঞ্চলগুলো মানি লন্ডারিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এটা আমরা যাচাই করে দেখতে পারি। পানামা হচ্ছে হাজার হাজার গোপন কর্পোরেশন নিবন্ধীকরণের একটা কেন্দ্র। এই কর্পোরেশনগুলো মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও অন্যান্য বেআইনী কর্মকা-ে সহায়তা যোগায়। এসব ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে লড়তে হলে প্রতিটি কর্পোরেশনের চূড়ান্ত মালিক কে সন্ধান করে বের করার জন্য একটা রেজিস্ট্রি গঠন করা দরকার। আমাদের প্রাথমিক বৈঠকে কিছু কিছু পানামীয় সদস্য এ বিষয়টিরও বিরোধিতা করেছিল। কিছু দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র আছে যেগুলোর গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা অপরাধ, দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিংয়ের সহায়ক। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সুযোগ দেয় বলেই কেবল গোপনীয়তা রক্ষার এই স্বর্গরাজ্যগুলো রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে এই স্বর্গরাজ্যগুলো কাজ করতে পারত না। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী মার্কিন অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিজ ও আইনের অধ্যাপক মার্ক পাইন পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিটিতে ছিলেন। পরে সেখান থেকে তারা পদত্যাগ করেছিলেন। কেন করেছিলেন ‘টাইম’ সাময়িকীতে উভয়ের লেখা এই নিবন্ধে তার উল্লেখ আছে। মূল : স্টিগলিজ অনুবাদ : এনামুল হক সূত্র : টাইম
×