ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মো. জাভেদ-হাকিম

গহীনের সৌন্দর্য রাইক্ষং

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২৬ আগস্ট ২০১৬

গহীনের সৌন্দর্য রাইক্ষং

তিন পায়ে হেঁটে পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য দেখার সুবর্ণ সুযোগ আর কিছু হতে পারে না। আর সেই পাহাড় যদি হয় তিন পার্বত্য জেলায় তাহলে তো কথাই নেই। পায়ের নিচে মেঘ-বৃষ্টি আর বিদ্যুত চমকানোর অসাধারণ সব দৃশ্য। যে পাহাড়ের ওপর দিয়ে হাঁটছি সেখানে প্রখর রৌদ,্র অথচ পাশের পাহাড়েই ঝরছে ঝুম বৃষ্টি। মেঘ-রোদ আর বৃষ্টির অপূর্ব মিতালি। কখনও বা আবার আচমকা শুভ্র মেঘমালা আপনার দেহকে ঘিরে ধরে মনের মাঝে ছড়িয়ে দেবে এক অন্যরকম ভাললাগার দ্যুতি! সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের ঘোর কাটতে না কাটতেই আপনার পিছু নেবে আরও নতুন কোন কিছু দেখার রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এসব কিছুরই শিহরিত অনুভব পাওয়া যাবে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় পনেরো শ’ হতে পঁচিশ শ’ ফিট ওপর দিয়ে পাহাড়, বন-জঙ্গল আর সুমিষ্ট পানির ছড়া দিয়ে দু-পার সঙ্গে টেকসই একটা লাঠি নিয়ে হেঁটে বেড়াবেন। দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বেড়াতে হাতের লাঠি অতিরিক্ত পা হিসেবে দারুণ কাজে লাগে। আমাদের এ্যাডভ্যাঞ্চার প্রিয় দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের এবারের ভ্রমণ ছিল বান্দরবানের উঁচু উঁচু পাহাড়, খরস্রোতা খাল আর আদিবাসী পাড়া পেরিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার গহীনে সৌন্দর্যের আধার রাইক্ষং ঝরণার প্রান্তরে। দলে ছিলাম ছয়জন, লাইটার করিম ভাই ছাড়া সবাই ছিলাম সবল! তবে মানসিকভাবে তার ছিল অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল। বগালেক হতে ভোর সাতটায় আল্লাহর নাম নিয়ে জুতসই বাঁশের লাঠি সম্বল করে দু-পায়ের ওপর ভর করে হাঁটা শুরু। ঢেউ খেলানো সারি সারি পাহাড়, ছড়া- ঝিড়ি মাড়িয়ে শুধু এগিয়ে যাচ্ছি। কখনও দু-হাজার ফিট ওপরে, কখনও বা আবার দেড় হাজার ফিট নিচে এভাবেই চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চড়াই-উৎরাই। কোথাও যে একটু নিশ্চিন্ত মনে জিরিয়ে নেব, শিকারি জোঁকের কারণে সেই সুযোগটুকু নেই। বেশ কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর নাখজং পাড়ার দেখা পেলাম আদিবাসী মুরংদের বসতি। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রামের পাশাপাশি সঙ্গে নেয়া মুড়ি চানাচুর তেল দিয়ে মেখে বেশ মজা করে খাই। খাওয়া শেষে আবারও হাঁটা। গন্তব্য পুকুরপাড়া। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে থমকে যেতে হবে, তবেই না পাওয়া যাবে পাহাড়ে ঘোরার আনন্দ। পাথর আর পানি ডিঙ্গিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলা। এনোংপাড়া আসতেই প্রায় সন্ধ্যা। ডানে তাকিয়ে দেখি বিশাল বিশাল গাছ আর জঙ্গলে ঘেরা ইয়া উঁচু এক পাহাড়। পুকুরপাড়া যেতে হলে এই পাহাড়টি ডিঙ্গাতে হবে। এবার হয়ত ঢাকা থেকে বয়ে আনা রশির বস্তা কাজে আসবে। স্যালাইন খেজুরছড়ার পানি পান করে আবারও হাঁটা। এবার দুই পাহাড়ের মাঝে সরু পথ দিয়ে যেতে হবে। কিছুদূর যেতেই দেখি গাছের পাতায় পাহাড়ের ভাঁজে ঝুরঝুরে পাথুরে মাটিতে পাহাড়ের সবচাইতে ভয়ঙ্কর টাইগার জোঁক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যেন মনে হয় মানুষের রক্তের স্বাদ নেয়ার জন্য আনন্দে নৃত্যরত। ইফতেখার তো ভয়ে শিশুদের মতো কেঁদেই ফেলল। কান্না কিংবা হাসি যেটাকেই বেছে নেই না কেন, এই দম বন্ধ হওয়া সৌন্দর্যের পথ পারি দিয়ে প্রকৃতির অপার বিস্ময় রাইক্ষং ঝরনায় পৌঁছতেই হবে। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। এই দুর্গম নির্জন পাহাড়ে বিনা রক্তপাতে সেটা আশাই বা করি কিভাবে। যতটা সম্ভব দ্রুত হাঁটছি। দেহের রক্ত চোষা যে শুরু হয়ে গেছে, তা একটু আধটু টেরও পাচ্ছি। বন্ধুদের কুপ্পি, কাইত কুপ্পি কাইত {অবস্থা খারাপ} চিৎকারে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য কোন হিংস্র জন্তু হয়ত পালিয়েছিল। যাক বাবা দ্রুত হাঁটার জন্য সময় তো বাঁচল। আনুমানিক প্রায় পঁচিশ ফিট উপরে যাওয়ার পর আমাদের চোখ ছানাবড়া, ওয়াও! একি দেখছি দৃষ্টিরসীমা যতদূর যায় শুধু সবুজে মোড়ানো দিগন্ত ছোঁয়া পাহাড়ের ঢেউ। পুকুর পাড়া আর্মি ক্যাম্পের পাদদেশেই বিশালাকার টলটলে পানির লেক। চার পাশে পাহাড় মাঝখানে অবিশ্বাস্যকর সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক লেক। ভাবুন তো একবার ওমন পরিবেশে কেমন লাগবে আপনার? ক্লান্তি কি কখনও আচ্ছন্ন করতে পারবে? এবার প্রাংজাংপাড়া পেরিয়ে পুকুরপাড়া সুজন মাস্টারের কটেজের দিকে অগ্রসর হই। কটেজে কাঁধের ঝোলা রেখে দেশী পেয়ারা চিবিয়ে নবউদ্যমে হাঁটি। ঘণ্টাখানেক নিচের দিকে হাঁটার পর শুনতে পাই সেই কাক্সিক্ষত কলকল রিমঝিম ছন্দ তোলা নৈসর্গিক শব্দ। চলবে...
×