ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ কে এম এ হামিদ

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ রুখতে যেতে হবে চেতনার ভিত্তিমূলে

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৬ জুন ২০১৬

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ রুখতে যেতে হবে চেতনার ভিত্তিমূলে

বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে ব-দ্বীপে বসতি গড়ে উঠেছে প্রায় ৪ হাজার বছর পূর্বে। প্রাচীন জনপদ হলেও সভ্যতার তেমন বিকশিত হতে পারেনি এই জনপদ। তবে একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি টিকে ছিল যুগে যুগে। প্রকৃত অর্থে কোন পর্যায়েই সম্পূর্ণ স্বাধীন ও একতাবদ্ধভাবে আপন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি এ জনপদ। তবে ব্যতিক্রমী ধ্যান-ধারণা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে কখনও কারও সম্পূর্ণ অধীনতাও স্বীকার করেনি এ জনপদের মানুষগুলো। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় অনেক বিদ্রোহের জন্ম হয়েছে এ অঞ্চলে। প্রকৃতিগতভাবে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল বার বার লুণ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন বেনিয়া গোষ্ঠীর দ্বারা। ফলে স্থানীয় ও বিদেশী শাসক দ্বারা শাসিত হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষ। খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ এবং পরবর্তীতে খুব কম সময়ের জন্য শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা ক্ষমতা দখল করে। পরবর্তী প্রায় এক শ’ বছরের অরাজকতা শেষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ প্রায় চার শ’ বছর শাসন করে। এরপর সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। দ্বাদশ শতকের বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান ও যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ষোড়শ শতকে মুঘল শাসকগণ বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে এবং ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার শাসনভার চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে। দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে এ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ভাবতে শুরু করে। প্রথমেই তারা আঘাত হানে বাঙালীর মাতৃভাষার ওপর। যে কারণে ১৯৫২ সালে সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালী তাদের প্রথম স্বাধিকারের বীজ বপন করে। ইতিহাসের এক একটি পর্ব অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তৈরি হতে থাকে নিজস্ব স্বাধিকারের জন্য। এর মূলে যে চেতনাটি কাজ করেছে- সেটি ছিল বৈষম্যের অবসান। বাঙালী সম্প্রদায়ের প্রতি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে প্রথমত দাবি উত্থাপন করে স্বায়ত্তশাসনের। অর্থাৎ পাকিস্তানী রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে থেকে নিজেরা নিজেদের শাসন করবে। তারা অধিকার আদায়ে সংগ্রামমুখর হলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বল প্রয়োগের আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে বাঙালীদের কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে, স্বকীয়তা রক্ষা, বৈষম্যের অবসান ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো প্রয়োজন। এ কারণেই ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। যেটি ছিল বাঙালীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। কৃষ্টি, কালচার, ভাষা, মর্যাদাবোধ, জীবিকা ও জীবন বৈচিত্র্যের মাঝেই খুঁজে পায় মানুষ তার নিজস্ব সত্তা। দেশ ও জাতিসত্তাবিলীন কোনভাবেই মানুষ মেনে নিতে পারে না। একইভাবে বিচ্ছিন্ন চেতনায় জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব নয়। এই অনুধাবন থেকে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষ সংঘবদ্ধ হতে থাকে। গড়ে তোলে সমাজব্যবস্থা। যা কালক্রমে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে পরিণত। এই জাতিরাষ্ট্র গঠনের পেছনে মানুষের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে। যা অপরাপর জাতি-গোষ্ঠী থেকে পৃথক সত্তার জানান দেয়। এখানে মাতৃভাষা ও প্রবাহমান জীবন বৈচিত্র্যই মুখ্য ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ শাসন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির যে সনদ বাঙালী রচনা করেছিল ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেখানেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এটি নিছক একটি স্বাধীন ভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চেতনার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। এখানে বিশেষ কতগুলো প্রতিশ্রুতিও জড়িত ছিল। যেগুলোকে জাতির অগ্রগমনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের সেই অনুপ্রেরণা-চেতনা, বাঙালীর ব্যক্তি বা সমষ্টির মননে; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে জানা ও ধারণ করা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে চেতনা ছিল সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত, অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠা। যেটির ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছে। যেখানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো ১৯৭৫ পরবর্তীতে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে ধারার রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার সবকিছুই ছিল অনুপস্থিত। এ সময়ে শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার স্বার্থে প্রজন্মের কাছে বিকৃতভাবে স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরে। গণতন্ত্র চর্চার অনুপস্থিতিতে যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে নাগরিক তৈরির মূল সূতিকাগার শিক্ষাকে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে বিন্যাসিত করা হয়নি। শাসকদের সুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখানে বহুধা বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। অন্যদিকে মধ্যবিত্তের জন্য যে বাংলা মাধ্যম শিক্ষা প্রচলিত রয়েছে, সেখানে গ্রাম ও শহরের মাঝে এক ধরনের বৈষম্য দৃশ্যমান। আত্মকেন্দ্রিকতাড়িত এ শিক্ষায় ব্যক্তি নাগরিক রাষ্ট্র থেকে যতটা পেতে উদগ্রীব, দেশ ও জাতিকে দেয়ার মানসিকতায় ততটা দৃঢ় নয়। ফলে দেশপ্রেমহীন একটি প্রজন্মের ওপর ভর করে চলছে প্রিয় মাতৃভূমি। যাদের সামনে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত নেই। বরং, দীর্ঘ অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভর করে যে রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে তারা শিখেছে কিভাবে জাতীয় অর্থ লুণ্ঠন করা যায়। কিভাবে ব্যক্তি মানসের চাহিদা ও আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য জাতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। অন্যের অধিকার সুরক্ষার মধ্য দিয়ে নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের প্রক্রিয়াটি তারা গ্রহণ করতে পারেনি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে। ফলে নাগরিক স্বাধীনতায় যে দায়বদ্ধতা, সেটি উপেক্ষিত হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের আচরণে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের হতাশা। এই সামষ্টিক হতাশাই আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানী ভাবধারায় পরিচালিত সরকারগুলোর নানামুখী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অব্যাহত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের ফলে হারিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের মহান স্বাধীনতার মর্ম কথাগুলো। দীর্ঘদিন সংগ্রামের পর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েও জনগণের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি পূরণে বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার জন্য খুব বেশি সুসংগঠিত কার্যক্রম বা পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের সকল শক্তি নিয়ে সংগঠিত হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নানামুখী অপতৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনজীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। এমনি পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে রুখে দিতে হলে সমগ্র জাতিকে চেতনার ভিত্তি মূলে যেতে হবে। সমগ্র জাতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পূর্ণরূপে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস শেখ হাসিনা সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে কালবিলম্ব জাতিকে আবারও পিছিয়ে দিতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ একক জাতিসত্তায় ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে- ক. প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। এই জাতীয় কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদের ২/৩ জন সদস্য, সংশ্লিষ্ট ৩/৪ জন সচিব, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জাতীয় পর্যায়ের পেশাজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতৃবৃন্দকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। খ. তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একক জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের দেখভাল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষক, শ্রমিক, পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই নির্বাহী কমিটির কাজের সুবিধার্থে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তৃত করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি দেশব্যাপী অর্থাৎ গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত সর্বত্র স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তথা রাষ্ট্রবিরোধীদের চিহ্নিত করে তা সরকারকে অবহিত করাসহ একক জাতিসত্তার সার্বভৌম একটি গণমুখী রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একক জাতিসত্তা গড়তে করণীয়: জাতির সরল ধর্মীয় ভাবনা ও বিশ্বাসের ঐতিহ্যকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক চক্র বা শক্তি আজ মারমুখী হয়ে উঠেছে। সেই অপশক্তিকে রুখতে এবং স্বাধীন-সার্বভৌম উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের মূলভিত্তি তথা গণতন্ত্র-বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ একক জাতিসত্তায় ঐক্যবদ্ধ একক জাতি হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ২কেননা, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২য় ও ৩য় বারে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়ার পর ভিশন ২০২১ এর ভিত্তিতে জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথে ধাবিত করার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তাতে দেশের জনগণ আশান্বিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আবারও ১৯৭১ সালের ন্যায় একক জাতি সত্তায় রূপান্তরিত হচ্ছে, তখন দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাকে বাধাগ্রস্ত ও দিকভ্রান্ত করার নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ সালে এবং ১৯৭১ ও ১৯৭৫ সালে বাঙালী জাতি একইভাবে জাতিসত্তায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যখনই দ্রুত অগ্রযাত্রার পথে ধাবিত হচ্ছিল, তখনই চক্রান্তকারীরা জাতিকে দিকভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র করেছে। ফলে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর পরও দিকভ্রান্ত জাতি একই ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হওয়ার প্রেক্ষিতে একক জাতিসত্তার সুদৃঢ় ঐক্য দানা বাঁধতে পারেনি। ২এমনি পরিস্থিতিতে বাঙালী জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একক জাতিসত্তায় গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত জরুরী সিদ্ধান্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ/কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মনিটরিং সেল’ গঠন করে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। এই সেলে কঠোর ও সুদৃঢ় মনোভাবনাসম্পন্ন ত্যাগী ও আপোসহীন কর্মীকে নিয়োগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে নি¤েœাক্ত বিষয়সমূহ সুবিবেচনাপূর্বক জরুরী সরকারী নির্দেশনা জারি ও পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হলো : ১.দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষা বর্ষের কর্মপরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা ও শহীদ দিবস উদ্যাপন, রচনা প্রতিযোগিতা, জাতির পিতার সংগ্রামী জীবন, আলোচনা অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা নির্দিষ্ট করে সরকারী নির্দেশনা জারি করতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় দৈনিক ক্লাস শুরুর প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত এ্যাসেম্বলিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক জাতি গঠনার্থে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং ২/৩ বাক্যের একটি শপথনামা/অঙ্গীকারনামা সমস্বরে পাঠ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়নে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসব বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ দায়ীদের ভাতা ও সরকারী অনুদান বন্ধ করে দিতে হবে। ২.স্কুল-মাদ্রাসা লেভেলে ৩টি পাবলিক পরীক্ষায় পঞ্চম/ অষ্টম/১০ম শ্রেণীর সমাপনী প্রতিটি পরীক্ষাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের ১টি প্রতিবেদন/ প্রবন্ধ জমা দেয়াসহ মৌখিক/লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। বিষয়সমূহ হতে পারে- -বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস -১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ -জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা -১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের দেশী-বিদেশী বিরুদ্ধাচরণের স্বরূপ ও হীন উদ্দেশ্য -মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। -বছরে ২/১ বার প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রযুক্তি ও কৃষিমেলা আয়োজন করে সাধারণ বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোকে ভিডিওর মাধ্যমে প্রচার করে পর্যায়ক্রমে উগ্র ধর্মান্ধতার অবসান ঘটানো। ৩.কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি চূড়ান্ত পরীক্ষা (উচ্চ মাধ্যমিক, ¯œাতক ও ¯œাতক-উত্তর) পরীক্ষায় নি¤েœাক্ত যে কোন একটি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও ১টি থিসিস জমা দিতে হবে। বিষয়গুলো হতে পারে- -’৫২ থেকে ’৭১ জাতিসত্তার বিকাশ ও মহান স্বাধীনতা -বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও জাতিসত্তার বিকাশ -মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ জাতি গঠনে সুশাসন -মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক মুক্তি -জনগণের ন্যূনতম মৌলিক ৫টি (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা) চাহিদা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র -দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জাতি গঠন বা মাতৃভূমির প্রতি দায়বোধ -বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক জাতি গঠনের লক্ষ্যে প্রতিবছর মেলা আয়োজনের ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদগণ সামগ্রিক বিষয় নির্ধারণসহ শিক্ষা ব্যবস্থায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করবেন। ৪.প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রাথমিক নিয়োগ ও পরবর্তী পদোন্নতির ক্ষেত্রে আগামী ১৫ বছরের জন্য নি¤েœাক্ত পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেতে পারে- ক্স প্রাথমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে- -বিষয়ভিত্তিক লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা : ১০০ নম্বরের পরীক্ষা -মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বিষয়ে লিখিত, মৌখিক ১০০ নম্বরের পরীক্ষা এবং এনএসআই, এসবি, ডিজিএফআই রিপোর্ট ইত্যাদি : ক্সপদোন্নতির ক্ষেত্রে নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো মূল্যায়নপূর্বক পদোন্নতি প্রদান -মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা -অঈজ/ চবৎভড়ৎসধহপব ৎবঢ়ড়ৎঃ -কর্মকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও চেতনাভিত্তিক কি কি কার্যক্রম করেছে -মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোন কার্যক্রম পরোক্ষ প্রত্যক্ষ সংযোগ সম্পর্কিত এনএসআই, এসবি, ডিজিএফআইএর প্রতিবেদন সংগ্রহ করা। ৫.দেশের প্রাইভেট শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বীমা ও যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নি¤েœাক্ত বার্ষিক/ দ্বিবার্ষিক কার্যক্রম মূল্যায়ন শেষে ব্যাংক হিসাব/ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। -প্রতিষ্ঠানটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোন প্রত্যক্ষ পরোক্ষ কার্যক্রমে জড়িত ছিল কিনা। -প্রতিষ্ঠানটি স্ব-উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক জনকল্যাণমূলক কোন কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা। -প্রতিষ্ঠানের সিএসআর (ঈড়সসঁহরঃু ঝড়পরধষ জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু) ফান্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক কার্যক্রমে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে। ৬.দেশের সব রাজনৈতিক দলকে জাতীয় সংসদের সদস্য পদে মনোনয়ন দেয়ার পূর্বে নি¤েœাক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে আইনের মাধ্যমে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। -মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতাবিরোধী কোন কার্যক্রম পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল কিনা। -রাজনৈতিক জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কি কি কার্যক্রম বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। -ব্যক্তিগতভাবে বিগত জীবনে পিএসআর (চবৎংড়হধষ ঝড়পরধষ জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অর্থ ব্যয় করাসহ দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিনা। ৭. দেশের শাসন ব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে প্রচলিত আইন পরীক্ষান্তে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক সকল অংশ সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসিক্ত আইন প্রণয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধ, মহান স্বাধীনতাবিরোধী সব কার্যক্রম, বক্তব্য বিবৃতি আইনত কঠোর দ-নীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সামারি ট্রায়ালে শাস্তির বিধান করা। বাঙালী জাতির চিরন্তন হৃদয় নিঃসৃত অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মহান স্বাধীনতার স্তম্ভ। যা জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনার নীরব সাক্ষী ও সুদৃঢ় চেতনার প্রতীক। দেশের আপামর জনতার মহৎ দেশপ্রেম জ্বলে ওঠার সে অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দুগুলোর প্রতি সমগ্র জাতিকে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। সে সব জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে কটাক্ষ বা অবহেলা করা আইনত দ-নীয় গণ্য করে বিধিবিধান প্রণয়ন করা। লেখক : সভাপতি, আইডিইবি ও কো-চেয়ারম্যান, (এসডিইএফ), সম্পাদক, কারিগর
×