ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে দিনে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস

মহেশখালী থেকে ৯১ কি.মি. পাইপলাইনের কাজ শেষ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৫ জুন ২০১৬

মহেশখালী থেকে ৯১ কি.মি. পাইপলাইনের কাজ শেষ হচ্ছে

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম ভাসমান এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) টার্মিনাল। সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনুস্বাক্ষরিত চুক্তিটি সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদিত হয়ে যাওয়ায় নতুন গতি পেয়েছে এ প্রকল্প। মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার পথে। এ গতিতে কাজ এগোলে আগামী ২০১৮ সালের প্রথমার্ধেই এ টার্মিনাল হয়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে জাহাজযোগে আমাদনি করা বিদেশী গ্যাস। আর এর মাধ্যমে পূরণ হবে দেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী গঠনগুলোর দীর্ঘদিনের একটি দাবি। কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি হলো সিঙ্গাপুরভিত্তিক ‘এ্যাস্ট্রা অয়েল এ্যান্ড এক্সিলারেট এনার্জি কনসোর্টিয়াম’। তবে বাংলাদেশে কোম্পানিটি কাজ করবে এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড হিসেবে। ২০১৪ সালের ২৬ জুন এ কোম্পানির সঙ্গে টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা। গত ২২ জুন সচিবালয়ে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে টার্মিনাল স্থাপনের জন্য পেট্রোবাংলা ও এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের মধ্যে সম্পাদিত খসড়া ‘টার্মিনাল ইউজ এ্যাগ্রিমেন্ট, ইনপ্লিমেন্টেশন এ্যাগ্রিমেন্ট’ ও ‘সাইড লেটার এ্যাগ্রিমেন্ট’ চূড়ান্ত অনুমোদিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে পেট্রোবাংলা ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির মধ্যকার চুক্তিটি চূড়ান্ত অনুমোদন লাভের পর মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প পেয়েছে নতুন গতি। পাইপলাইন স্থাপনের কাজ অনেক আগে থেকেই চলছিল। আগামী মাসের মধ্যেই ৯১ কিলোমিটার পাইপলাইনের কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এলএনজি টার্মিনালকে কেন্দ্র করে মহেশখালীতে অর্থনৈতিক কর্মকা-ও ক্রমেই চাঙ্গা হচ্ছে। ভাসমান এলএনজি টার্মিনালকে ঘিরে পরিলক্ষিত হচ্ছে ব্যাপক আগ্রহ। গ্যাসের অভাবে মুখথুবড়ে থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও আশাবাদী হয়ে উঠেছে। এছাড়া ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা। দেশে গ্যাস সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে এলএনজি টার্মিনালের কোন বিকল্প নেই বলে জোরালো অভিমত রেখে আসছিলেন শিল্পোদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালেই এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় এ উদ্যোগ দীর্ঘসূত্রতার আবর্তে পড়ে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হলে কক্সবাজারের মহেশখালীতে এ টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের তালিকায় রাখা হয়। শুরু হয়ে যায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। পাইপলাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হতে থাকে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের কর্মযজ্ঞ। মহেশখালী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার পাইপলাইনের অধিকাংশ দৃশ্যমান হয়ে যাওয়ায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ নিয়ে আর কোন সংশয় নেই ব্যবসায়ী মহলে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারসহ বিভিন্ন ট্রেডবডি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে দেশে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিল। কেননা, গ্যাসের তীব্র সঙ্কটের মুখে ব্যাহত হচ্ছে দেশের শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন। অনেক প্রতিষ্ঠানই কারখানা গড়ে উৎপাদন শুরু করতে পারছে না গ্যাসের অভাবে। যাত্রা শুরুর আগেই ব্যাংকঋণের সুদ গুনতে গুনতে দেউলিয়া হওয়ার পথে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। তাছাড়া নতুন শিল্পায়নও স্থবির হয়ে পড়ে গ্যাস সরবরাহ না থাকায়। বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস সেক্টরে সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখন তাকাতে শুরু করেছে বাংলাদেশের দিকে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, এক লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। চুক্তি অনুযায়ী টার্মিনাল নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ বাবদ এক্সিলারেট এনার্জিকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের জন্য ৪৯ সেন্ট করে পরিশোধ করবে পেট্রোবাংলা। তবে এর সঙ্গে আরও কিছু খরচ যুক্ত হয়ে ব্যয় দাঁড়াবে ৫৯ সেন্টে। মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করবে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রসঙ্গত, ব্যবসায়ীদের প্রধান দুটি দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল এলএনজি টার্মিনাল। অপর দাবিটি ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন মহাসড়ক। গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানার উৎপাদনের চাকা সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় আমদানির কাঁচামাল ও রফতানির পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছিল। দেশের রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী প্রধান সড়কটিতে যানবাহনের মাইলের পর মাইল লাইন একেবারে স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের। মহাসড়ক ফোর লেনে উন্নীতকরণের কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে। এখন চলছে দুয়েকটি জায়গায় ওভারপাস, আইল্যান্ড ও বিউটিফিকেশনের কাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন সড়ক উদ্বোধন করবেন। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জনসাধারণ ফোর লেনের সুবিধা ভোগ করে আসছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দুই প্রধান নগরীর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নীত হতে যাচ্ছে অন্য এক উচ্চতায়। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে দূরত্ব কমতে যাচ্ছে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি জনমনে স্বস্তি এসেছে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা দূর হওয়ায়।
×