ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

ফলই গাছের পরিচয় বহন করে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৭ মার্চ ২০১৬

ফলই গাছের পরিচয় বহন করে

১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। তিন বছর অন্তর কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও এবার সেটি হলো ছয় বছর পর। ২০০৯ সালে ৫ম কাউন্সিল হয়েছিল ১৬ বছর পর। ওই ১৬ বছর তারা ক্ষমতায়ও ছিল এবং বিরোধী দলেও ছিল। কিন্তু কাউন্সিল করেনি। কাউন্সিল একটি রাজনৈতিক দলের জন্য শুধু নিয়ম রক্ষা, শো-ডাউন বা লোক দেখানোর জন্য নয়। দল ও রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কাউন্সিলের প্রধান কাজ হয় বিগত বছরগুলোর কর্মকা-ের নিখুঁত পর্যালোচনাপূর্বক ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করা এবং সময়োপযোগী নীতি-আদর্শ ও আগামী দিনের চলার পথ ঠিক করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল দলের কাঠামোতে কিছু নতুন পদ সৃষ্টি ব্যতিরেকে যা কিছু হয়েছে তার সবই ছিল নিয়ম রক্ষা ও শো-ডাউনের অংশবিশেষ। কমিটি গঠন অথবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদের ঘোষণা, যা সব সময়ই হয়ে থাকে তাও হয়নি। এমন কি দীর্ঘ সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত থাকা মহাসচিবের ভারটুকুও মুক্ত হলো না। তবে আরেকটি কাজ হয়েছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে তারেক রহমানের একটি বিবৃতি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সম্মেলনে প্রচার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক তারেক রহমান এখন পলাতক আসামি হওয়ায় তার রাজনৈতিক বক্তব্য বক্তৃতা প্রচার করা নিষিদ্ধ। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়ার এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের দীর্ঘ ভাষণ শুনে কেউ ভাবতে পারেন ১৯ মার্চ বোধহয় সদ্য নতুন একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হলো, যারা আগামীতে ক্ষমতায় গেলে ১৬ কোটি মানুষ দুধে-ভাতে সাঁতার কাটতে পারবেন। বিএনপি নামক বৃক্ষটির বয়স এখন ৩৭ বছর। এত বছর ধরে কি রকম ফল বিএনপি বাংলাদেশের মানুষকে খাইয়েছেন তা ভাষণ লেখকগণ ভুললেও দেশের মানুষ এমন মিষ্টি ফলের কথা এত তাড়াতাড়ি কি করে ভুলে যায়। শত হলেও একজন বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার গড়া দল। যিনি তাঁর মহান মহানুভবতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শত্রু গণহত্যাকারী, ধর্ষণকারী যুদ্ধাপরাধীদের সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার সুযোগ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাগ্যবান দল বিএনপি। ৩৭ বছরের মধ্যে তারা প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতায় থেকেছে, যা দলের বয়স ও ক্ষমতায় থাকার আনুপাতিক হিসেবে অন্য কোন দলের ভাগ্যে জোটেনি। জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের সামরিক শাসন বিএনপির ভাগ্য উন্মোচনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। জিয়াউর রহমান তাঁর সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে মুক্তি সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের সকল আদর্শ ও দর্শনকে সংবিধান এবং রাষ্ট্রের সব জায়গা থেকে নেই করে দেন, যার ধারাবাহিকতা এরশাদ রক্ষা করেছেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে একই রাষ্ট্রীয় ধারা বহাল থাকায় তার একটা ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় রাষ্ট্রের সকল জায়গায়। ওই সময়ে বেড়ে ওঠা কয়েকটি নতুন প্রজন্মের বড় একটি অংশ বাস্তব কারণেই সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। জেনারেল এরশাদ কর্তৃক সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের প্রবর্তন বিএনপির আদর্শিক ধারাকে আরও শক্তিশালী করে। এগুলো আজও বিএনপির রাজনীতির চালিকাশক্তি। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে জেনারেল এরশাদ যদি ক্ষমতা দখল না করতেন তাহলে ছাত্তার সরকার যেভাবে দুর্নীতি আর সন্ত্রাসে ডুবে গিয়েছিলেন তাতে পরবর্তী ছয় মাস-এক বছরের মাথায় ওই সরকারের ভয়ঙ্কর পতন ঘটত। তাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামরিক শাসকদের গড়া রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপি প্রথমে ছত্রভঙ্গ এবং পরে কালের বিবর্তনে নেই হয়ে যেত। এই অবস্থায় নির্বাচন হলে একমাত্র সংগঠিত দল হিসেবে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসত। তখন সময়ের প্রয়োজনে শূন্যস্থান পূরণে আওয়ামী লীগের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শধারী আরেকটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপক্ষের রাজনীতি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। এগুলো পুরনো কথা হলেও এসবের প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই উল্লিখিত প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখেই বিএনপির সদ্যসমাপ্ত কাউন্সিলের আলোচনা পর্যালোচনা করতে হবে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের প্রস্তাব দেয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণে কিছুটা চমক সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভাষণ লেখকদের চাতুর্যও মানুষ কিন্তু ধরে ফেলেছে। বাংলাদেশে এখন সুপরিচিত কিছু তথাকথিত নিরপেক্ষ ভাবধারী মানুষ উঠেপড়ে লেগেছে যে কোনভাবে হোক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে। তাতে বদরপ্রধান নিজামী প্রধানমন্ত্রী হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। এদের ভেতর বড় একটি এনজিও মিডিয়া, অন্য কিছু বিদেশী অর্থে চালিত এনজিও, দলছুট কিছু রাজনীতিক এবং এদের সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন। এদের রাষ্ট্র ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের আকাক্সক্ষা প্রবল। তবে এরা কোনদিন নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতার বারান্দায় উঠতে পারবেন নাÑ একথা তারাও বোঝে। শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়, এই ফর্মুলায় ওই গোষ্ঠীকে চাঙ্গা রাখার জন্য তাদের সামনে বড় একটা মুলা ঝুলিয়ে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণ লেখকগণ, দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাবের মাধ্যমে। পত্রিকায় দেখলাম দলের সিনিয়র নেতারা এসব বিষয়ে কিছুই জানতেন না। গণতন্ত্র উদ্ধার এবং মুক্ত করবই গণতন্ত্র। চমকপ্রদ সেøাগান, সন্দেহ নেই। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ গণতন্ত্র নিয়ে এখন ধান্ধায় আছে এবং বিভ্রান্তিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান নিজেকে গণতান্ত্রিক শাসক হিসেবে প্রচার চালাতেন, যা আমরা নিজেরা দেখেছি ও শুনেছি। গণতন্ত্রের নাম গন্ধ নেই, অথচ দেশের নামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে গণতান্ত্রিক দেশ। যেমন, ভূতপূর্ব পূর্ব জার্মানির নাম ছিল জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক। বর্তমান উত্তর কোরিয়ার অফিসিয়াল নামÑ ডেমোক্র্যাটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া। গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চরম একনায়কতান্ত্রিক সরকারের ঘোর সমর্থক। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি আছে একথা সবাই স্বীকার করেন। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক পত্রিকার ইন্টেলিজেন্স শাখার জরিপ মতে, বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক সূচকে ২০১০ সালে বাংলাদেশ পূর্বের অবস্থান থেকে আট ধাপ এগিয়ে ৮৩তম স্থানে আসে। ২০১৪ সালের সর্বশেষ অন্য একটি জরিপে আরও তিন ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন ৮০তম স্থানে আছে। অর্থাৎ গত ছয়-সাত বছরে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সূচক পিছনে যায়নি, বরং যতটুকু হোক এগিয়েছে। আমরা অবশ্যই আরও সামনে যেতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্র হারাম মতধারী জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে হেফাজতের ১৩ দফার সমর্থক হয়ে বিএনপি গণতন্ত্রের অগ্রসরতা কিভাবে ঘটাবে তার কোন ব্যাখ্যা বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণের মধ্যে পাওয়া যায়নি। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি চালু রেখে, রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র সাম্প্রদায়িক রেখে গণতন্ত্রের অগ্রায়ন কিভাবে ঘটাবে তার কোন পথ বিএনপি দেখাতে পারেনি। কোন শক্তি ইচ্ছা করলেই আকাশ থেকে গণতন্ত্র নেমে আসবে না। তার জন্য এই পথের মৌলিক বাধাগুলো দূর করতে হবে। এই প্রসঙ্গে বিএনপির কোন অঙ্গীকার নেই বরং এই জায়গায় বিএনপি নিশ্চুপ। কাউন্সিল থেকে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, রাজনীতিতে সমঝোতার কথা বলেছেন। এগুলো ভাল কথা, নেতানেত্রীগণের থেকে এমনটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কথা অন্য জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী কোটি কোটি মানুষ জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আল বদরদের সঙ্গে তো ঐক্য করবে না, এক মঞ্চে বসবে না, এক প্ল্যাটফরমে কখনো আসবে না। তাহলে জামায়াত, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে থেকে বিএনপি কিভাবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে। এটিই এখন সবচাইতে বড় মৌলিক প্রশ্ন। হেফাজতের ১৩ দফাকে সেদিন বিএনপি যেভাবে সমর্থন দিয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্য সবই বিনষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে কাউন্সিল থেকে নতুন কোন বার্তা পাওয়া যায়নি। চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়া না হওয়ার বিষয়টি জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষ দলমত নির্বিশেষে এই বিচার চায় এবং উপযুক্ত শাস্তি কার্যকর হওয়া চায়। কিন্তু ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর রোডমার্চ শেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনসভায় সকল যুদ্ধাপরাধীকে রাজবন্দী দাবি করে বেগম খালেদা জিয়া তাদের মুক্তি দাবি করেন। বিএনপি থেকে একাধিকবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বন্ধের দাবিও তোলা হয়েছে। সুতরাং ৩৭ বছরের পুরনো এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপি এখন আর নতুন গজানো গাছ নয় যে মানুষ চিনতে ভুল করবে। বঙ্কিম চন্দ্রের কমলাকান্তের দফতর একখানা অপূর্ব উপন্যাস। আফিম খোর কমলাকান্তের মুখে বঙ্কিম অসাধারণভাবে বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে মনুষ্য চরিত্রকে বিশ্লেষণ করেছেন। বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে গাছ ও ফলের প্রতীকে শ্রেণীভেদে মানুষের ব্যাপারে অসামান্য একটা উদাহরণ দিয়েছেন। এই জায়গায় এসে কমলাকান্ত বলছেনÑ আফিমের একটু বেশি মাত্রা চড়াইলে আমার বোধহয়, মানুষ্যসকল ফলবিশেষ মায়াবৃন্তে সংসার বৃক্ষে ঝুলিয়া রহিয়াছে, পাকিলেই পড়িয়া যাইবে। সবগুলো পাকিতে পারে না, কতক অকালে ঝরে পড়িয়া যায়। কোনটি পোকায় খায়, কোনটি পাখিতে ঠোকরায়। কোনটি শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে। কোনটি সুপক্ব হইয়া আহরিত হইলে গঙ্গাজলে ধৌত হইয়া দেবসেবায় বা ব্রাহ্মণভোজনে লাগেÑ তাহাদেরই ফলজন্ম বা মনুষ্যজন্ম সার্থক। কোনটি সুপক্ব হইয়া বৃক্ষ হইতে খসিয়া মাটিতে পড়িয়া থাকে, শৃগালে খায়। তাহাদের মনুষ্যজন্ম বা ফলজন্ম বৃথা। কতকগুলো তিক্ত, কটু বা কথায়Ñ কিন্তু তাহাতে অমূল্য ঔষধ প্রস্তুত হয়। কতকগুলো বিষময়Ñ যে খায় সেই মরে। আর কতকগুলো মাকাল জাতীয়-কেবল দেখিতে সুন্দর। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×