ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

পোল্ট্রি শিল্প ॥ হাজার কোটি টাকার সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ মার্চ ২০১৬

পোল্ট্রি শিল্প ॥ হাজার কোটি টাকার সম্ভাবনা

দেশীয় পুঁজি এবং দেশীয় উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই শিল্পটি দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। পোল্ট্রি ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমুখী একটি সমৃদ্ধ শিল্প। বিশেষত আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই শিল্প নতুন বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে। শুধুমাত্র সরকারের অপেক্ষায় বসে না থেকে এবং চাকরিনির্ভরশীল না হয়ে আমাদের যুব-যুব মহিলারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে সমৃদ্ধ অর্থকরী শিল্পে পরিণত করেছে পোল্ট্রি শিল্পকে। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। এখানে যেসব মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত, তার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের বিকাশমান এই শিল্পটি। নীরবে ঘটে চলেছে বিপ্লব পোল্ট্রি শিল্পটি বড় হচ্ছে নীরবে নিভৃতেই। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এ শিল্প থেকে আসছে। বর্তমান বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ফিড মিলে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২৫ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন এবং লোকাল উৎপাদন প্রায় ১ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমান বাজারে মুরগির মাংস ও ডিম সবচেয়ে নিরাপদ খাবার। মুরগির বিষ্টা দিয়ে এখন বায়োগ্যাস ছাড়াও তৈরি হচ্ছে জৈব সার। আত্মকর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্য দিগন্ত পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে পরিচালনা, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ এবং খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমের সুবাদে আরও ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে ব্যবসা এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে পোল্ট্রি শিল্প। জানা গেছে, পোল্ট্রি শিল্পে ছোট বড় খামার রয়েছে ৭০ হাজারের বেশি। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, প্রায় ১ লাখ প্রাণী চিকিৎসক, পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ, নিউট্রিশনিস্ট সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। বেসরকারীভাবে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ রয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। শিল্পের গোড়াপত্তন যেভাবে তথ্য উপাত্তে জানা যায়, বিকাশমান পোল্ট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ৯০-এর দশকে। তারও আগে ১৯৬৪ সালে ৩০ একর জমির উপরে গাজীপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে পোল্ট্রি শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। তবে ১৯৯৫-৯৬ সালে দেশী ও সোনালি জাতের মুরগির বাইরে উন্নত জাতের লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির চাষে খামারিরা ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। এর ফলে দেশের জনগণ আয়-উপার্জনের সামঞ্জস্যতায় ডিম ও মুরগির মাংস খেতে পারে। গ্রামে-গঞ্জে গেলে এখন দেখা যাবে যেসব পরিবার বছরে দুই ঈদ ছাড়া মাংসের স্বাদ পেত না, পোল্ট্রির কল্যাণে তারা সহসাই ডিম ও মাংসের স্বাদ নিতে পারছে। মেহমানকে আপ্যায়ন করতে পারছে। পূরণ হচ্ছে আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা। গ্রামীণ পর্যায়ে এই শিল্পের কল্যাণে যুব নারী ও যুবকেরা নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন, নিজের স্বকর্মসংস্থান এবং অপরের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। সম্ভাবনা অফুরন্ত- লক্ষ্য ২০২১ সাল এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক শতাংশ আসে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। গার্মেন্টসের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। এ খাতে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ জড়িত। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। আর বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব হলে ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১২০০ কোটি ডিম ও ১০০ কোটি ব্রয়লার উৎপাদন সম্ভব হবে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের তথ্য থেকে জানা যায়, ডিম ও মুরগির মাংস রফতানি করে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। এই সেক্টরে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। এছাড়াও পোল্ট্রি লিটার থেকে বছরে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২১ সাল নাগাদ পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। তখন বাংলাদেশে ডিমের দৈনিক চাহিদা হবে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি। এ সময়ের মধ্যে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ। তখন দেশের বৃহত্তর খাত হিসেবে পোল্ট্রি শিল্প আত্মপ্রকাশ করবে। বলা হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই শিল্পে। জাতীয় স্বার্থে এই শিল্প রক্ষায় সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবসম্মত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশীয় বেকারত্ব নিরসনের স্বার্থে দেশীয় খামারিদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রণোদনা সহায়তা দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং খামার পুনরায় চালু করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। পোল্ট্রি শিল্পকে বীমার আওতায় আনতে হবে। পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ সহজ ও শুল্কমুক্ত করতে হবে। ডিম আমদানি যাতে না করতে হয় সেজন্য দেশীয় পোল্ট্রি উদ্যোক্তাদের সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা স্থায়ী সমাধানের পথ খুলে দিবে। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
×