ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

কয়া থেকে শিলাইদহ বাঘা যতীন ও রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কয়া থেকে শিলাইদহ  বাঘা যতীন ও রবীন্দ্রনাথ

(শেষাংশ) সম্ভবত উত্তরোত্তর ধূমায়িত রাজরোষ প্রশমিত করবার অভিপ্রায়ে সহসা অরবিন্দ-সম্পাদিত পত্রিকা ‘বন্দে মাতরম’কে ঠেস দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘দেশহিত’ প্রবন্ধে সমালোচনা করলেন সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণের প্রতিবাদে। প্রয়োজনের প্রলোভনে ধর্মকে বিসর্জন দিলেই বিশ্বাসের বাঁধন আলগা হয়ে যায়, “অধর্মই ভয়ংকর সর্বনাশ সাধন করে... আমরা শনির সঙ্গে কলির সঙ্গে আপাতত সন্ধি করিয়া মহৎ কার্য উদ্ধার করিব- ইহা ভ্রম।...ফললাভ চরম লাভ নহে, ধর্মলাভই লাভ।” ১৯০৮ সালের মে মাসে রবীন্দ্রনাথ কবুল করলেন : “আমাকে লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে আমি আজ পর্যন্ত গীতা শেষ অবধি ভাল করে তলিয়ে পড়িনি।” তা সত্ত্বেও গীতার ফলবাদের সঙ্গে বাইবেলে বর্ণিত নিষিদ্ধ ফলের জন্য স্বর্গভ্রষ্ট হবার তত্ত্বের সাদৃশ্য তিনি দেখেছেন। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তখন আমেরিকায়। সঙ্গে আছেন অবলা বসু আর নিবেদিতা। এঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথের এই অভিমত “যথেষ্ট দেশপ্রেমিকের উক্তি” বলে মেনে নিতে পারলেন না। লেডি বসু তাঁর মন্তব্য ব্যক্ত করে এক আত্মীয়ের কাছে যে-পত্র লিখলেন, তা রবীন্দ্রনাথের নেত্রগোচর হলে কবি একটি কৈফিয়ৎ পাঠালেন : “দেশকে ছাড়িয়ে যদি ধর্মকে যদি বিশ্বমানবকে না দেখতে পাই, যদি দেশের সংস্কারে আমার ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করে তা হলে আমি আমার আত্মার খাদ্য হতে বঞ্চিত হই।” ১৯১৫ সালের গোড়ায় দীর্ঘকালের বন্ধু ও বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে, মাখন সেন ও রামচন্দ্র মজুমদারের সহযোগিতায় নৌকো নিয়ে গঙ্গা পার হয়ে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে রামরাজাতলা পৌঁছলেন। ১৯১০ সালে অরবিন্দ চন্দননগর থেকে পণ্ডিচেরী যাবার স্মৃতি অন্তরে জাগ্রত রেখে রামচন্দ্র সাশ্রু নয়নে মাখন সেনকে বললেন : “বাংলার প্রাণ আজ আপনার হাতে দেওয়া হলো।...নিজের দায়িত্ব বুঝে নেবেন!” যতীনের অনুরক্ত কর্মী সত্যেন মজুমদার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলেন, দক্ষিণেশ্বর থেকে শ্রীমা সারদা দেবী একই ট্রেনের যাত্রী। সাগ্রহে তিনি যতীনকে ডাক দিলেন। প্রণাম গ্রহণ করে শ্রীমা যতীনকে পাশে বসিয়ে ঘোমটা খুলে তার সঙ্গে কথা বলছেন দেখে ভক্তেরা বাইরে অপেক্ষা করতে গেলেন। যতীন চলে গেলে শ্রীমা বিমর্ষ মুখে সত্যেনকে বললেন : “দেখলাম আগুন!” বাগনানে ট্রেন থামল। উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং “যুগান্তর”-এর সক্রিয় কর্মী অতুলচন্দ্র সেনের এই আশ্রয়ে ক-দিন কাটালেন যতীন। অতুলচন্দ্র ছিলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের ভাইপো এবং বিপ্লবী কর্মবীর খগেন দাশগুপ্তের মাসতুতো ভাই। পরবর্তীকালে ক্যালকাটা কেমিক্যাল্সের পরিচালক খগেন জানান যে, অতুলচন্দ্রের বাড়িতে ওই সময় তিনি প্রায়ই ডাঁই করা টাকা দেখেছেন; অতুলচন্দ্র বলতেন : “লঙ্কার ব্যবসায় নেমেছি!” অতুলচন্দ্রের স্কুলের হেড পণ্ডিত হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন ওই দলে; পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মহিষাদলের উপকণ্ঠে তাঁর গ্রাম কুমার-আড়ায় ছিল যতীন মুখোপাধ্যায়ের বালেশ্বর অভিযানের শেষ পান্থ-নিবাস। দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বস্বপণ করে দলপতির সঙ্গে অনির্দিষ্ট কালের জন্য হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, নীরেন্দ্র দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত; এঁদের উত্তর-কৈশোরের স্বপ্ন চরিতার্থ করবার সাধনায় দাদা যতীন মুখোপাধ্যায়ের এই কপ্তিপোতার আশ্রমে এঁরা পরম আনন্দে নিরুদ্বিগ্ন দিন কাটাছেন। সঙ্গে আছেন যুবক নলিনীকান্ত কর আর জ্যোতিষচন্দ্র পাল; শেষোক্ত জন বিবাহিত, একটি শিশুকন্যার পিতা। আশ্রয়দাতা মণীন্দ্র চক্রবর্তী এঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সদাসচেতন। খেলাধুলো, গুলি চালানো, কুস্তি, সাঁতারের প্রতিযোগিতাÑ তার সঙ্গে এঁরা যতীনের কাছে পেতেন বাংলা ও ইংরেজির পাঠ, করতেন ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি বিষয়ে আলোচনা। প্রতিদিন সূর্যাস্তের মুহূর্তে একটি গাছের তলায় সমবেত হয়ে তাঁরা শুনতেন যতীনের গীতাপাঠ ও ব্যাখ্যা। নলিনীকান্তের ভাষায় : “দাদা গেরুয়া পরে থাকতেন। দেখতে পাঞ্জাবী সন্ন্যাসীর মতো। গলায় একটা রুদ্রাক্ষ বাধা ছিল।” একদিন, গীতাপাঠের শেষে অভ্যাসমতো যতীন ধ্যানে বসেছেন। অদূরে বসে আছেন মণীন্দ্র। হঠাৎ, ভাবগ্রস্ত যতীন ডাক দিলেন মণীন্দ্রকে: “দাদা, ওই যে, দেখ। আমার কৃষ্ণ আমার দিকে চেয়ে হাসছেন!” কলকাতা থেকে ভগ্নদূতের মতো হাজির হলেন যদুগোপাল। পেনাং-এর একটি পত্রিকায় অস্ত্রবাহী জাহাজ ধরা পড়বার দুঃসংবাদ বেরিয়েছে। পুরো একটি যুগের এই একক প্রয়াস ধূলিসাৎ দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে চির প্রশান্ত যতীন মুখোপাধ্যায় হেসে বললেন : “ভগবান শুধরে দিলেন। আমরা বিদেশের সাহায্যে দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। দেশ কিন্তু নিজের জোরে দাঁড়াবে। অপরের সাহায্যে নয়!” যদুগোপালের মন্তব্য : “তাই বলতে পারি তিনি ছিলেন রূপমূর্ত গীতা।” সংবাদ পৌঁছলো রবীন্দ্রনাথের কাছে। কয়া থেকে শিলাইদহে আসা-যাওয়ার দিনগুলো স্মরণে রেখে কবিগুরু বললেন : “এতকালের পরাধীন দেশে এ মৃত্যুও ছোট নয়। কিন্তু যতীনের জীবনের সাধনা...” যতীনের পথের পথিক একাধিক সুধীজনকে কাছে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়ে শুনিয়েছেন ‘বলাকা’র সেই কবিতা : “ওরে তোদের ত্বর সহে না আর?” শ্রোতাদের অনুমান, স্নেহভাজন যতীন মুখোপাধ্যায়ের উদ্দেশেই কবিতাটি রচিত। দীর্ঘকাল যতীন প্রসঙ্গে সরাসরি কোন উক্তি কবি না করলেও যতীনকে আশ্রয় দেবার অপরাধে বাগনানের অতুলচন্দ্র সেন যখন গ্রেফতার হন, তখন তাঁর স্ত্রী কিরণবালা সেনকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন : “তোমার স্বামীর অন্তরায়ণ সংবাদ আমি পূর্বেই শুনিয়াছি। কি কারণে তাঁহার এই বিপত্তি ঘটিল তাহা কিছুই জানি না। এ সম্বন্ধে রাজপুরুষদের নিকট আমি পত্র লিখিয়াছি। তাহার কোন ফল হইবে কিনা তাহা বলা যায় না। তোমরা যে দুঃখ ভোগ করিতেছ ভগবান তোমাদের সেই দুঃখকে কল্যাণে পরিণত করুন এই কামনা করা ছাড়া আর আমাদের কিছু করিবার নাই।” প্রশান্তকুমার পাল ‘রবিজীবনী’র ৭ম খণ্ডে আরো কিছু তথ্য সরবরাহ করেছেন। যতীন মুখোপাধ্যায়ের অনুরাগী অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষেরও বন্দীদশায় মরণোন্মুখ দুরবস্থা জেনে বাংলার গভর্ণরের একান্ত সচিবের কাছে আবেদন পাঠিয়ে অসুস্থ জ্যোতিষচন্দ্রের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৯ সালের মে মাসে, কংগ্রেস থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতি-পদ ত্যাগের পিঠপিঠ ‘দেশনায়ক’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ অভিনন্দন জানান : দেশের মধ্যে প্রবীণ ও নবীনদের দ্বন্দ্বের এই মুহূর্তে সুভাষচন্দ্রকেই তিনি নেতৃত্বের উপযুক্ত মনে করেন। প্রবন্ধটি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্রজীবনী’র ৪র্থ খণ্ডে উদ্ধার করে জানিয়েছেন কী হেতু লিখিত ও মুদ্রিত হওয়া সত্ত্বেও ভাষণটি অপ্রকাশিত থেকে গেল : হেতু হলো কবির শুভার্থী ও তৎকালীন বিশ্বভারতীর হিতৈষীদের পরামর্শ। এই ভাষণেইÑ সম্ভবত উক্ত শুভার্থীদের ভাষণেÑ যতীন মুখোপাধ্যায়ের নাম না করেও অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে কবি তাঁর কথা স্মরণ করেছেন: “বাংলাদেশের ইচ্ছার মূর্তি একদিন প্রত্যক্ষ করেছি বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলনে। বঙ্গকলেবর দ্বিখণ্ডিত করবার জন্যে সমুদ্যত খড়্গকে প্রতিহত করেছিল এই ইচ্ছা। যে বহুবলশালী শক্তির প্রতিপক্ষে বাঙালী সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেই রাজশক্তির অভিপ্রায়কে বিপর্যস্ত করা সম্ভব কিনা এ নিয়ে সেদিন সে বিজ্ঞের মতো তর্ক করেনি, বিচার করেনি, কেবল সে সমস্ত মন দিয়ে ইচ্ছা করেছিল। “তার পরবর্তী কালের প্রজন্মে (মবহবৎধঃরড়হ) ইচ্ছার অগ্নিগর্ভ রূপ দেখেছি বাংলার তরুণদের চিত্তে। দেশে তারা দীপ জ্বালাবার জন্যে আলো নিয়েই জন্মেছিল, ভুল করে আগুন লাগাল, দগ্ধ করল নিজেদের, পথকে করে দিল বিপথ। কিন্তু সেই দারুণ ভুলের সাংঘাতিক ব্যর্থতার মধ্যে বীর হৃদয়ের যে মহিমা ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন, ভারতবর্ষের আর-কোথাও তো দেখিনি। তাদের সেই ত্যাগের পর ত্যাগ, সেই দুঃখের পর দুঃখ, সেই তাদের প্রাণ নিবেদন, আশু নিষ্ফলতায় ভস্মসাৎ হয়েছে, কিন্তু তারা তো নির্ভীক মনে চিরদিনের মতো প্রমাণ করে গেছে বাংলার দুর্বার ইচ্ছাশক্তিকে। ইতিহাসের এই অধ্যায়ে অসহিষ্ণু তারুণ্যের যে হৃদয়বিদারক প্রমাদ দেখা দিয়েছিল, তার উপরে আইনের লাঞ্ছনা যত মসী লেপন করুক তবু কি কালো করতে পেরেছে তার অন্তর্নিহিত তেজস্ক্রিয়তাকে?” যতীন মুখোপাধ্যায় জানতেন তাঁর অতি স্পর্ধিত বিপ্লব-পরিকল্পনা এতদিনের পরাধীন দেশে রাতারাতি সাফল্য লাভ করবে না। খুব সরল ভাষায় তিনি বিপ্লবের যে-ছক এঁকে গিয়েছিলেন, তার মূল শিক্ষা ছিল “ঠেলায় ঠেলায় জাতি জাগিয়ে” তোলবার সাধনা। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে যা “আশু নিষ্ফলতায় ভস্মসাৎ হয়েছে”, ইতিহাসের চোখে তা অন্য এক তাৎপর্য লাভ করেছে : যতীন মুখোপাধ্যায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিপ্লবের পরবর্তী প্রেরণা পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো সেই ভস্মস্তূপ দীর্ণ করে গণ-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। নাগপুর কংগ্রেসের প্রাক্কালে যতীন মুখোপাধ্যায়ের হাতে গড়া “যুগান্তর”-কর্মীদের প্রতিনিধি রূপে ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত পণ্ডিচেরী গিয়ে শ্রীঅরবিন্দের অনুমোদন পেলেন সাময়িকভাবে গাঁধীজীর সহযোগিতা করবার সপক্ষে। যতীন মুখোপাধ্যায়ের এই চেলাদের উৎকর্ষে মুগ্ধ হয়ে ১৯২৫ সালে গাঁধীজী টেগার্টের কাছে যতীন মুখোপাধ্যায়ের প্রশস্তি করেন “দিব্য ব্যক্তিত্ব” অভিধায়। উল্লেখপঞ্জি * অজিতকুমার চক্রবর্তী, “মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর”, ইণ্ডিয়া প্রেস, এলাহাবাদ, ১৯১৬ * প্রশান্তকুমার পাল, “রবিজীবনী”, আনন্দ পাব্লিশার্স, কলকাতা (৭ খণ্ড) * প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, “রবীন্দ্রজীবনী”, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ৪র্থ খণ্ড, ৩য় সংস্করণ, ১৪০১, পৃঃ ১৯৭ * পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, “সাধকবিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ”, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ২য় সংস্করণ, ২০১২ * পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (সহ-সম্পাদক: পবিত্রকুমার গুপ্ত), “সমসাময়িকের চোখে বাঘা যতীন”, সাহিত্য সংসদ, ২০১৪ * “রবীন্দ্র রচনাবলী”, বিশ্বভারতী, খণ্ড ১, ২, ৫, ১৭, ১৮ * ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, “পারিবারিক কথা”, সরস্বতী প্রেস, কৃষ্ণনগর, ১৯৪৭ * Prithwindra Mukherjee, Bagha Jatin : Life and Times of Jatindranath Mukherjee, National Book Trust, New Delhi, 1st revised edition, 2013 * Prithwindra Mukherjee, Bagha Jatin : The Revolutionary Legacy, Indus Source Books, Mumbai, 2015 * Prithwindra Mukherjee, Bagha Jatin : Life in Bengal and Death in Orissa (1879-1915), Manohar, New Delhi, 2016
×