ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে সংসদে তুলকালাম ;###;অতীতের রায় অসাংবিধানিক হলে তিনি নিজেও অসাংবিধানিক হয়ে যান ;###;মানুষ মনে করবে ওনার কোন এজেন্ডা আছে ;###;ওনার বক্তব্যের পর বিএনপি বলেই ফেলেছে- এই সরকার অবৈধ

বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখা ॥ অসাংবিধানিক নয়

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখা ॥ অসাংবিধানিক নয়

সংসদ রিপোর্টার ॥ অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্যে নিয়ে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত বিতর্ক হয়েছে। বিতর্কে অংশগ্রহণকারী সংসদের সিনিয়র সদস্যরা প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখা কোনভাবেই অসাংবিধানিক নয়। অতীতের রায় অসাংবিধানিক হলে রাষ্ট্রের সকল ভিত্তিই তো অসাংবিধানিক হয়ে যায়, প্রধান বিচারপতি নিজেও অসাংবিধানক হয়ে যান। তাঁরা বলেন, বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে উনি যা-তা বলতে পারেন না। আর কারও কথায় সংবিধান অসাংবিধানিকও হয় না, সাংবিধানিকও হয় না। পিছনে গিয়ে যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে কথা বলে অকারণে এই দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টির কোন কারণ নেই। তা করা হলে মানুষ মনে করবে আপনার (প্রধান বিচারপতি) কোন এজেন্ডা আছে। নিশ্চয়ই কোন অসাংবিধানিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে সাংবিধানিক শক্তি এই কথা বলছে। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হকও প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, অবসরের পর রায় লেখা অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক। কিন্তু আমাদের সংবিধানে কোন আর্টিকেলে লেখা নেই যে, বিচারপতি অবসর গ্রহণের পরে আর রায় লিখতে পারবেন না। সেটাই যদি হয় তাহলে সেটা অসাংবিধানিক হতে পারে না, আইনের ভাষাতেও অসাংবিধানিক নয়। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত বিতর্কের সূত্রপাত করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী। বিতর্কে অংশ নেন প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক এবং সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু। তাঁরা সবাই প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে, অবসর গ্রহণের পর বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবেন না। বিতর্কে অংশ নিয়ে প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করা আছে। এই তিনটি অঙ্গ একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রধান বিচারপতি বলে বসলেন, জুডিশিয়ারির ক্ষমতাকে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এটা বলা যায় না। এ বক্তব্যে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আবার উনি বলে বসলেন, অবসরের পর রায় লেখা হলে তা হবে অসাংবিধানিক। এটা অসাংবিধানিক হলে রাষ্ট্রের সকল ভিত্তিই তো অসাংবিধানিক হয়ে যায়, প্রধান বিচারপতি নিজেও অসাংবিধানক হয়ে যান। তিনি বলেন, এ ধরনের কোন বক্তব্য জুডিশিয়ারির হেড থেকে আসা মানেই হচ্ছে দেশটা অস্থিতিশীল হোক। সাবেক বিরোধী দল সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে লুফে নিয়ে বলে বসল, সরকারে নাকি ভূকম্পন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এই সংবিধান অনুযায়ী আমরা চলছি। প্রধান বিচারপতি একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি বলা শুরু করল- এই সরকার অবৈধ! এটা নিয়ে হঠাৎ করে কথা এসেছে যখন বাংলাদেশের রাজনীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, সুপ্রীমকোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানকে নির্বাহী ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। সেইখান থেকে যদি এ ধরনের একটি মন্তব্য চলে আছে যে এটি অসাংবিধানিক, এটি অবৈধ, তা সত্যিই দুঃখজনক। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, কারও কথায় সংবিধান অসাংবিধানিকও হয় না, সাংবিধানিকও হয় না। সুতরাং যে রেওয়াজ চলে আসছে, সেই রেওয়াজ চলবে। আর যদি প্রধান বিচারপতি মনে করেন এই রেওয়াজটি খারাপ, এই রেওয়াজটি বন্ধ করে অন্য কিছু করতে চান- তাহলে তাঁকে রিট্টো-রেসপেকটিভ কিছু করা যাবে না অর্থাৎ পশ্চাতে ফিরে যাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই। তাহলেই মানুষ মনে করবে আপনার (প্রধান বিচারপতি) কোন এজেন্ডা আছে। আমরা ঘর পোড়া গরু। নিশ্চয়ই কোন অসাংবিধানিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে সাংবিধানিক শক্তি এই কথা বলছে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি এটাও করতে পরেন অবসর গ্রহণের তিন মাস আগে তিনি কোন জাজমেন্ট ঘোষণা করবেন না। এটা তিনি করতে পারেন। কিন্তু পিছনে গিয়ে যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে কথা বলে অকারণে এই দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টির কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, সুপ্রীমকোর্টকে জাতি সম্মানের সঙ্গে দেখে। এখানে দু-একজন বিচারকের ব্যক্তিগত কাদাছোঁড়াছুঁড়ি নিয়ে এই পবিত্র স্থানকে বিতর্কিত করা যাবে না। কারণ এটা সব বিচারের আশ্রয়স্থল। তাই এই বিষয়টি এখানেই নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচার বিভাগের প্রধান। কিন্তু তাঁর কিছু সমস্যা আছে আমরা জানি। কোন বিচারপতি রায় দেরি করে লিখলে জনগণ ভোগান্তির শিকার হয়। সেক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি একটি নির্দেশনা দিতে পারেন, একটি টাইমফ্রেম দিয়ে বলতে পারেন, এই সময়ের মধ্যে রায় লিখতে হবে। এটা গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, হাইকোর্ট ডিভিশনের যে রায় বিচারপতিগণ যতদূর সম্ভব, সেটা এজলাসে বসেই দেয়ার কথা। কিন্তু যদি এমন হয় এই রায়টা তারা শেষ করতে পারছেন না এজলাসে বসে, তাহলে এজলাসের বাইরে রায় লেখার অধিকার রাখেন। আপীল বিভাগে এ কথা লেখা নেই যে রায় এজলাসেই দিতে হবে। পরিষ্কার লেখা আছে রায় দিতে হবে কোর্টে। কিন্তু কোথাও লেখা নেই অবসরের পর রায় লেখা যাবে না। তাই অবসরের পর রায় লেখা অবৈধ নয়। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে নিয়ে বিএনপি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমাদের জনগণকে যারা বাসের মধ্যে পেট্রোলবোমা মেরে হত্যা করে তারা উনার (প্রধান বিচারপতি) বক্তব্য লুফে নিয়ে বলেন, সকল কাজকর্ম যা হয়েছে, রায় যা লেখা হয়েছে তা অসাংবিধানিক। আমার কথা এই যে, তাদের (বিএনপি) আবার সংবিধান পড়তে হবে। সংসদে যেসব বক্তব্য রাখা হয়েছে এটা যথার্থ। পশ্চাদে যা হয়েছে পিছুতে কোনভাবেই গ্রহণ করা হবে না, সামনের দিকে যেতে যদি কোন পরামর্শ থাকে তাহলে আমরা সেদিকেই যাব। আমরা আর পশ্চাতে ফিরে যাব না। পেছনের দিকে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, সংবিধানও সেই অধিকার দেয়নি। সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন, আমরা কিছু অনভিপ্রেত ইস্যুতে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। রায় ঘোষণা করতে হয় পাবলিকলি ওপেন কোর্টে। মূল রায়ের সংক্ষিপ্ত দেয়া হয়, পরে বিচারপতিরা যার যার পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন। এর ব্যত্যয় ঘটানোর কোন সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। উনি আস্থার প্রতীক। তাই উনি (প্রধান বিচারপতি) যখন যা ইচ্ছা তা বলতে পারেন না। উনার এ ধরনের মন্তব্যে না করাই শ্রেয় ছিল। বিতর্কের সূত্রপাত করে রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, আদালতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। করেও না। প্রধান বিচারপতি কিছু বক্তব্য রেখেছেন। সে বক্তব্য তিনি বার বা বেঞ্চ বা আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় দিতে পারতেন। আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি অনেক বিচারকরা রায় দিতে গিয়ে দেরি করেন তা বলতে গিয়ে কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য বির্তকের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, অবসরের পর রায় দেয়া সংবিধান পরিপন্থী। তবে আমাদের দেশে অতীতে অসংখ্য মামলার রায় পরবর্তীতে লেখা হয়েছে। এ নিয়ে কথা বললে অতীতের বড় রায়গুলো যে বিচারকরা দিয়েছেন, তারা বিব্রত হবেন। ভারত, শ্রীলঙ্কা এমন কী আমেরিকাতেও ছয় মাসও পর রায় লেখার নজির আছে। অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে যদি তিনি অতীতকে টানেন তবে বিব্রতর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে, সঙ্কটও তৈরি করবে। তবে ভবিষ্যতে কোন বিচারপতি অবসরের পর রায় লিখতে পারবে না এমন রুল তিনি দিতে পারেন। তাতে কোন সমস্যা নেই।
×