ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

বিমূর্ত ধারার পুরোধা ও নিরবচ্ছিন্ন শিল্পসাধক

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

বিমূর্ত ধারার পুরোধা ও নিরবচ্ছিন্ন শিল্পসাধক

একজন শিল্পী দক্ষতা ও সচেতন সংবেদনশীলতায় তৈরি করেন স্বপ্নময় পরিসর, যা আমাদের দৃষ্টিকে ভাবতে শেখায়, অনুভূতির জানালা খুলে দেয়, গভীরতায় নিমগ্ন হয় আনন্দ-বেদনা এবং ক্রমশই আবিষ্কৃত হয় দৃশ্যমান শিল্পের সত্য। চিত্রশিল্পে ধীরস্থির অথচ গতিশীল ভারসাম্য বজায় রেখে সুদীর্ঘ সময় ধরে যে একজন ব্যক্তিত্ব তার ধীর, শান্ত অথচ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এ দেশের চিত্রকলার অঙ্গনে নিরলস পদচারণা করে গেছেন, যিনি এ দেশের শিল্পধারাকে নতুন এক দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন তিনি মোহাম্মদ কিবরিয়া। নির্বস্তুক চিত্রকলার ক্ষেত্রে যে ক’জন শিল্পী আমাদের শিল্পচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছেন শিল্পী কিবরিয়া তাতে নিঃসন্দেহে অগ্রণী। তিনি চারুকলা চর্চায় একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। বিমূর্ত চিত্রকলার এই ধারা পরিচিত ‘কিবরিয়া ধারা’ বলে। গত পাঁচ দশকের চিত্রকলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ধারাটির প্রভাবই সব থেকে গভীর ও ব্যাপক। তিনি মা, মাটি আর মানুষের ছবি এঁকে গেছেন সারাটা জীবন। দেশের মাটিকে খুব ভালবাসতেন তিনি। গভীর মমতায় পর্যবেক্ষণ করতেন মাটির ধূসর, গৈরিক, পাটকিলে, ছাই রঙের বৈচিত্র্য। সেই সব রং তুলে আনতেন তাঁর ছবিতে অসাধারণ টেক্সচার, সুষমামণ্ডিত সমন্বয় আর অনিন্দ্য বিন্যাসে। শুধু রঙেই ছবি। আর কিছু নেই। তবু সেই ছবির দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভুমে ছোট শহর শিউড়ির এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি মোহাম্মদ কিবরিয়া জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছবি আঁকতেন। রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্র প্রদর্শনী দেখে তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। নিজ শিল্প ইচ্ছা তিনি দেখতে পেয়েছেন তাঁদের চিত্রকলায় অর্থাৎ একজন শিল্পী হওয়ার আকাক্সক্ষার সাহস পেয়েছেন। মূলত এ প্রদর্শনীগুলোই তাঁর শিল্পী হওয়ার বাসনাকে জাগ্রত করেছিল। কিবরিয়া ১৯৪৫ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫০ সালে স্নাতক অধ্যায় শেষ করে ঢাকায় চলে আসেন। শিল্পকর্ম রচনা ছিল তাঁর কাছে গভীর সাধানার বিষয়। বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্রকলার চর্চায় এবং ছাপচিত্রে তিনি যে মৌলিকত্ব, সৃজন প্রতিভা এবং উৎকর্ষ দেখিয়েছেন তার তুলনা বিরল। কিবরিয়ার শিল্পকর্মে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল রং ব্যবহার করে সার্থকভাবে রেখা ও রঙের প্রলেপে উপস্থাপন করেছেন গতিময় সময়কে। প্রথম পর্যায়ের কাজে বাস্তবধর্মিতা পরিলক্ষিত হয়। ১৯৫০ থেকে ’৫৯ পর্যন্ত বাস্তবধর্মী, দ্বিমাত্রিক সেমি কিউবিক ও আধা বিমূর্ত রীতিতে কাজ করেছেন এবং তৎকালীন শিল্পের আন্তর্জাতিক সমসাময়িক ধারাতেও সমান দৃষ্টি রেখে স্বকীয়তার সন্ধান করে চলেছেন। কিবরিয়ার জীবনের সঙ্গে তাঁর শিল্পের পথচলা কখনও কখনও সমান্তরাল, বিশেষ করে শিল্প যখন তাঁর ব্যক্তি জীবনের অন্তর্গত নানা টানাপোড়েন ও চিন্তা-অনুভূতিকে ভাষা দিয়েছে। বাল্যকালের নিঃসঙ্গতা এবং স্মৃতি তাঁর ছবিতে প্রভাব ফেলেছে। আবার জীবন সম্পর্কে তাঁর যে দৃষ্টি, যেখানে ক্ষয় এবং বৃদ্ধির চক্রে তিনি প্রকৃতির নিয়মকে কার্যকর দেখতে পান, তারও একটা ভূমিকা আছে তাঁর ছবিতে। তাঁর ছবির পেছনে যতটা আবেগ, তার থেকে বেশি আছে চিন্তার সক্রিয়তা, একটি অনিবার্য কাঠামো চিন্তা, রং, রেখা, স্পেস এবং টেক্সচারের অন্তর্বয়ন। সেমি কিউবিক রীতিতে আঁকা ‘অবগাহন’ তেলচিত্রটি তাঁর প্রথম পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। কালচে সবুজ, হলুদ ও খয়েরি রঙের ছবিটির ফিগার দুটির বাহ্যিক রেখা স্পেচুলার সূক্ষ্ম আঁচড় দিয়ে নির্মিত, যার জন্য জ্যামিতির শক্ত সামর্থ্য কাঠামো সহজেই অনুভূত কিন্তু বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বহমানতা কিংবা গতিময়তা না হারিয়ে জলের স্রোতে দুটি ভাসমান নারী মূর্তি সময়ের অবগাহনে গা ভাসানোর সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছে। এ সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি ‘পূর্ণিমা’ শিরোনামে ক্যানভাসে তেল রঙে আঁকা অত্যন্ত সাফল্যজনক কম্পোজিশনে সেমি কিউবিক রীতিতে উপস্থাপিত বাড়ির আঙ্গিনায় শায়িত মা ও ছেলে, আকাশে চাঁদ, গাছপালা, ঘর ও দূরে জোনাকিরা। মা তার কোল থেকে আদরের শিশুকে আকাশ ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না দেখাচ্ছে। যেন বিস্মিত আলো আহ্বান করে বরণ করাবে তার সন্তানকে। দূরে জোনাকিরা নীল রঙের স্বপ্নময় আকাশে মৃদু জ্বলছে, আবছা আলোয় প্রকৃতি। কালচে মায়াময় নীলাভ রঙের ছবিটিতে সর্বোপরি জ্যোৎস্নার আলোকিত পরিবেশ যার মধ্যে একটি নাটকীয়তার সৃষ্টি করেছে। স্বপ্নময় নীল আকাশে অর্ধেক চাঁদ যেন উল্লসিত ক্যানভাসজুড়ে। ছবির দুটি ফিগারের মুখই প্রোফাইল ভঙ্গিতে। ফিগারের আউটলাইন স্পেচুলা দিয়ে অত্যন্ত গতিসম্পন্ন আকৃতিতে ক্যানভাসের তিন দিককার ফ্রেমে জ্যামিতিক আকারে বিন্যস্ত, যা শক্ত কম্পোজিশনের পরিচয় বহন করে। এখানে সাদা ক্যানভাস ছেড়ে তিনি কাজ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। শায়িত ফিগার দুটি হালকা সবুজ হলুদ রঙে গাঢ় নীল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ফুটে উঠেছে এক স্বপ্নময় পূর্ণিমার জ্যোৎস্না আহ্বানে। সেমি কিউবিক রীতিতে উপস্থাপিত ছবিটিতে দক্ষ জ্যামিতিক ফর্ম বণ্টন লক্ষণীয়। ‘অন্ধ দার্শনিক’ কালো রঙে আঁকা ছবিটিতে কালো রংটি অন্ধত্বের অনুভূতি আমাদের কাছে প্রকট করে অনুভূত করে। শিল্পী কিবরিয়াকে কালো বর্ণ এবং তার বিভিন্ন বর্ণস্তর ও গভীরতা সম্ভবত অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছে। কালোর রহস্যময়তাকে শিল্পী নানাভাবে নানা পর্যায়ে উন্মোচিত করেছেন। প্রথম পর্বে তিনি যা এঁকেছেন প্রায় সবই হয়েছে নিঃসঙ্গতার প্রক্ষেপণ। উদ্ভাসনার কাব্যিক ভাবানুভূতি ও রোমান্টিকতা সত্ত্বেও তাঁর ফিগাররা সব বিষণœ, ঠাণ্ডা, মৃত বাস্তবতার এক পাঁচালি। ‘চন্দ্রাহত ঘোড়া’ কিংবা ‘বৃষ্টিতে নৃত্য’ ওই পর্বের উজ্জ্বল নমুনা। এক সর্বগ্রাসী শূন্যতা ও নিয়তির বোধে তিনি তখন আক্রান্ত। তাঁর ফিগারগুলোতে সম্প্রসারিত করেছেন ওই বোধ, যার ফলে ফিগারগুলো হয়েছে প্রকাশভঙ্গিম। বিষয়বস্তুর সর্বময় প্রকাশ তিনি উচ্চকিত করেছেন ফর্মের মধ্য দিয়ে যত নয়, তারও বেশি রঙের মধ্য দিয়ে। তাঁর বিষণœ নীল, কৃষ্ণ-লালের ব্যবহার তারই ইঙ্গিতবহ। সেই সঙ্গে মিলেছে লাইনের ব্যবহার। জ্যামিতি প্রথমত, সর্বোপরি নমিত, নমনীয়। শিল্পী কিবরিয়ার কাছে রঙের ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছে সর্বদা। নীল, কালো, ধূসর, পাটকিলে, শেওলা সবুজ, হলুদ ও সাদা- এ ধরনের কিছু রং নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। তাঁর ছবি স্নিগ্ধ, মাধুর্যমণ্ডিত, বিনম্র। এক ধরনের নিঃসঙ্গ ধ্যানমগ্নতার দ্যোতনায় উদ্ভাসিত তাঁর চিত্রতল। উষ্ণ রঙের ব্যবহার শিল্পীকে খুব কমই প্রভাবিত করেছে। তাঁর অধিক নির্ভরতা হচ্ছে ধূসর, তামাটে এবং গেরুয়া রঙের ওপর। এর ফলে তাঁর ছবিতে আমাদের দেশের মেঘলা অপরাহ্নের বিষণœ নিষ্ক্রিয়তার ছায়াপাত ঘটেছে। ৫০-এর দিকে তাঁর ছবিতে শেওলা সবুজ, কালো, নীলচে সবুজের প্রাধান্য ছিল। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে যুক্ত হয় সাদা, হলদে, নীল, খয়েরি ইত্যাদি। কিবরিয়া তাঁর সত্তায় উপলদ্ধির একান্ত নির্জনতায় সত্যকে যেভাবে আবিষ্কার করেছেন, তারই দৃশ্যগত রূপান্তর ঘটিয়েছেন তাঁর চিত্রকর্মে অকুণ্ঠ বর্ণবিভার সাহায্যে। রঙের অপব্যয়ে নয় কিন্তু নিগূঢ়তম পরীক্ষার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যঞ্জনায় তার একটি যথার্থ প্রয়োগবিধি তিনি আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিধি প্রকরণের মধ্যে তাঁকে কখনও আবদ্ধ রাখা সম্ভবপর হয়নি। প্রতিবারই আবিষ্কারের মধ্যেই রঙের নির্মাল্য প্রত্যক্ষ করা যায়। কিবরিয়া তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অন্তঃসার থেকে রঙের স্বভাবকে আবিষ্কার করেছেন এবং নিজস্ব প্রয়োগ পদ্ধতি সুস্পষ্ট করেছেন। ‘ফুল হাতে বালক’ চিত্রটিতে দেখা যায়, বালক ও ফুল- এ দুয়ের পেছনে আছে এক ধরনের বিষণœতা। বালকের চোখে যেমন নেই উচ্ছ্বাস, তেমনি ফুলও ঠিক ফুল হয়ে ধরা দেয় না। এই ছবিতে ফুল বিষয়ক প্রথাগত রোমান্টিকতা নেই, আছে বিষণœতা অথবা অনিষ্পাপতা। ছবিটির কেন্দ্রে আছে বিষণœতা। ‘চন্দ্রালোকে ঘোড়া’ কিংবা ‘গোরস্তানে নৃত্য’ অতিপ্রাকৃত এবং বিষণœ, ভীত, নিস্তব্ধ মনলোকের ছবি। বিষণœ নীল আর কালচে লাল শীতল মৃত্যুময়তার প্রতীক হয়ে উঠেছে এসব ছবিতে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পড়ে থাকা ফিগার। দুঃস্বপ্নে অতল খাদের কিনারের অভিজ্ঞতার মতো। আবার ‘জলকেলি’ বা ‘পূর্ণিমার’ মতো ছবিতে মার্জিত রোমান্টিকতা প্রকাশ করেছেন। এসব ছবির আঙ্গিক কিউবিজম থেকে প্রাণিত। একটি শিল্পকর্ম ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে, ভিন্ন ভিন্ন আবেদনে ধরা দেয়। এমনকি সময়ের ভিন্নতায় একই ব্যক্তির কাছে ওই শিল্পকর্মের রূপ, অর্থ ও আবেদন বদলে যায়। জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তাঁর কাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এ সময় তাঁর কাজে কিউবিজমের প্রভাব দেখা যায়। পরবর্তীকাল থেকে তিনি বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারায় ছবি আঁকতে থাকেন এবং এটিই তাঁর প্রধান স্টাইল হয়ে দাঁড়ায়। আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুরণই বিমূর্ত শিল্পের প্রথম ও প্রধান দায়। অনুভব ও আবেগের বিশুদ্ধতাকে ধরার প্রয়াসের মধ্যেই বিমূর্ত চিত্রের সাফল্য, এখানেই কিবরিয়া অনন্য। বিমূর্ত চিত্রে আবেগের নিয়ন্ত্রণ বা রাশ টানতে পারাই চিত্রের মাধুর্যকে নির্মাণ করে। কিবরিয়ার চিত্রকর্মে এই নিয়ন্ত্রণের মাত্রাবোধের তুলনা কোন ইউরো-মার্কিন শিল্পীর শিল্পকর্মে বিরল। এই মাত্রা তাঁর শিল্পকর্মে এসেছে তিনি ভারতীয় বা এশিয় বলে, সঙ্গে তাঁর শৈশব শিক্ষা থেকে। এই মাত্রা তাঁর সচেতন প্রয়াস যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি অবচেতনের সজ্ঞা নিয়ন্ত্রীয়। জয়নুল, কামরুল, সুলতানের জনপ্রিয়তার মূলে যে ‘বাংলার মুখ’, কিবরিয়ার চিত্রেও সেই বাংলার মুখই উপস্থিত। তবে তা যেন গোধূলি আলোর আয়নায় দেখা। আপাতদৃষ্টিতে দরিদ্রতা নেই, ক্ষুধা নেই, সংগ্রাম নেই, নিবিড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ইবনে বতুতার দেখা সমৃদ্ধ বাংলা যেন কিবরিয়ার চিত্রে উঠে আসে হারানো মায়ের মুখচ্ছবির মতো। তাঁর কাজে কোন অবয়বের আভাস নেই। পেইন্টিং কিংবা ছাপচিত্রে সবক্ষেত্রেই তিনি একেবারে শুদ্ধ নির্বস্তুক। রং, রেখায় টেক্সচারে প্রতিটি কাজ আলাদা। লিথোগ্রাফ মাধ্যমে যে সমস্যা, সীমাবদ্ধতা এবং সুযোগ আছে তার পূর্ণাঙ্গ সফল ব্যবহার তিনি করেছেন। তিনি কখনই এই সীবাবদ্ধতা ভুলে যাননি। তাঁর লিথোগ্রাফ লেখার মতো। পাথরের উপর জলের খেলা, কন্টি, লাইন ও টেক্সচারের খেলা। একটা রঙের ওপর আরেকটা রঙের অনুভূতির খেলা। হালকা ও গাঢ় রঙের খেলা তিনি খেলেছেন তাঁর লিথোগ্রাফিতে, যেখানে বিষয়বস্তুর প্রাধান্য নেই। তাঁর চিত্রকলার মধ্যে কিংবা তাঁর রং ও লাইন ব্যবহারের মধ্যে বীজের মতো লুকানো নির্বস্তুক ও নৈর্ব্যক্তিক রীতি। জাপানি ছবির ওয়াশ টেকনিক ও সাদার ব্যবহার কিবরিয়াকে শিখিয়েছে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা ও স্পেসের নির্মিতি। এই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা তাঁর প্রকাশভঙ্গিমার মেজাজে এনেছে স্থায়িত্বের রোমাঞ্চ, স্পেসের নির্মিতি তাঁকে শিখিয়েছে রেখা ও রঙের মধ্যে আবেগের বহুস্তর উদ্ভাসনা। মনের প্রক্ষেপণকে কম্পোজিশনের শৃঙ্খলার মধ্যে সজ্জিত করে তোলা। কিন্তু স্পেসের সমস্যার নানা দিক তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে। কিবরিয়া একই সঙ্গে লড়াই করেছেন, এ্যাকশন পেইন্টিংয়ের, প্রতিবাদ করেছেন ও কেন্দ্রীয় প্রতীক তৈরি করে সুরিয়ালিজমের কবল থেকে মুক্তি খুঁজে চলেছেন। তাঁর ছবিতে মাধ্যমগত বিশেষত্ব লক্ষণীয়। তেল রঙের ছবি তেল রঙেরই আঁকা মনে হয়। কিংবা তাঁর লিখেগ্রাফে যে মিডিয়ার নিজস্বতা তা সহজেই অনুমান করা যায়। ষাটের দশকে শিল্পীকে বিমূর্ত প্রকাশবাদ আলোড়িত করেছিল। এ সময় তাঁর ছবিতে যুক্ত হয় বুনট ও স্পেস বিষয়ক অধ্যায়। কোন কোন ছবিতে কিউবিজমের কিছু ব্যবহার তিনি করেছেন। ‘তালগাছ ও বাবুই পাখি’ ছবিটিতে এ্যাবস্ট্রাকশন এসেছে ছবির কাঠামো বিন্যাসে। অন্য আরেকটি ছবি ‘পুতুল ও বালক’-এ ফিগারের উপস্থাপনা, রেখার ব্যবহার, সুষম বর্ণ লেপন- এসবের মধ্যেই এ্যাবস্ট্রাকশনের ঈঙ্গিত আছে। ফিগারের মধ্যে, রেখার মধ্যে এ্যাবস্ট্রাকশনের চমৎকার খেলা দেখা যায়। এই সময়ে করা সাদা-কালো কয়েকটি লিথোগ্রাফে জাপানি সৌম্য মনুমেন্টালিটি ও ওয়াশের পরিচর্যা দেখা যায়। ‘দুটি ফুল’ লিথোগ্রাফ পদ্ধতিতে করা। ছবির ফর্মগুলো পরস্পর সম্পর্কিত, নিষিক্ত, বিকর্ষিত হয় কিন্তু ছবিতে একটা ভারসাম্য সব সময় বজায় থাকে। ‘দুটি ফুল’-এ ফুলের দুই প্রতিরূপ বিমূর্ত দুটি ফর্ম, একটি পরিব্যাপ্ত পরিসরে স্থাপিত। তাদের ভেতরে মিল আছে, অমিল আছে। কিন্তু এক সময় বোঝা যাবে, এই দুটি ফর্ম আসলে সম্পর্কের অনিবার্যতার একটা চিন্তাকেই জাগিয়ে দেয়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে কিবরিয়ার ছবিতে রঙের ক্ষেত্ররা আবির্ভূত হতে থাকে। সেখানে আবদ্ধতা এবং অমুক্তির হাহাকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্রুশের মতো কম্পোজিশন। ‘ছাই’ শিরোনামের কোলাজগুলোতে আঁটসাঁট বর্গাকার ক্ষেত্রের মধ্যে পাথুরে বুনট দুঃসময়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সামাজিক সচেতন শিল্পী হিসেবেই স্বাধীনতাযুদ্ধ প্রভাব ফেলে তাঁর জীবন ও চিত্রকলায়। নীলচিত্র একটি ব্যথাতুর সময়ের প্রকাশ। সাফল্যজনকভাবে নীল রংকে বিভিন্ন আলোছায়ায় প্রকাশ করেছেন জমাট দুঃখবোধকে। ছবিটির মাঝখানে একটি কালো রঙের গভীর আকৃতি, যা প্রকাশ করে শিল্পীর অন্তরবেদনার কথা, তাঁর পরাধীনতার কথা। তেল রঙে আঁকা ‘ধাতব ধূসর আকৃতি’ চিত্রকর্মটি ১৯৭১ সালকেই মনে করিয়ে দেয়। একটি ফ্রেমকে পঁচিশ ভাগে ভাগ করে খণ্ড খণ্ড ঘরে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আবদ্ধ বেদনার আকৃতি। ‘সূর্যালোক’ চিত্রটিতে হেমন্তের সূর্যের আলোয় দৃশ্যত ফসলের মাঠ শস্য উৎপাদনক্ষম জমিন নয় যেন পোড়ামাটি, যেন ফসলের জমিন মরুভূমির মতো। এই পবিত্র আবাদভূমি শোষণ যন্ত্রণায় তার উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়েছে, আলোকিত সূর্য রক্তিম নয়, যেন শোষণ যন্ত্রণায় তিনি নবান্নের গান গাইতে পারছেন না। পক্ষান্তরে স্বাধীনতার আনন্দও তিনি অনুধাবন করাতে চেয়েছেন। ১৯৭৫-এর কালো ছবিতে কালো রঙের নানা মাত্রার ক্ষেত্রগুলো আর তাদের শরীরে ছড়ানো ছেঁড়া-কাটার মতো টেক্সচার দম আটকানো অনুভূতির জন্ম দেয়। দুই পাশে ধূসরতা ভেদ করে সাদা ক্ষেত্র দুটি অন্ধকারের সঙ্গে লড়ে যায় অবিরাম। এ সময়েরই কিবরিয়ার আরেকটি সিরিজ ‘স্মৃতি’ যেন অস্তিত্ববাদী ধূসরতার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে উদ্যত হয় রোমান্টিক কিবরিয়াকে। এচিংয়ে খুঁচিয়ে তোলা সারফেস, কাঁটার মতো রেখার ঝড়ো গতি ভিন্ন ভিন্ন কালের এবং কালপ্রবাহের আমেজ আনে। আশির দশকে কিবরিয়ার ছবি আবার বদলাতে শুরু করে। জমাট কম্পোজিশনের বর্গক্ষেত্রগুলো মিলিয়ে গিয়ে অসমান, অনির্ধারিত জমিনের রূপ নিতে থাকে। কম্পোজিশনের শুদ্ধতা রক্ষিত হয় না কিন্তু এসব শিথিলতার রাশ থেকে যায় শিল্পীর নিয়ন্ত্রণে। জ্যামিতির সামান্য করণে তিনি অশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। এর ভেতর দিয়ে লাল, নীল, কালো, ধূসর বা বাদামী রঙেরা তাঁর ক্যানভাসের স্পেসে যেন স্বয়ম্ভু হয়ে উঠে। নব্বই দশকে কিবরিয়া ক্যানভাসে এক জলজ প্রশান্তির আয়োজন করেন। সাদা স্পেস নির্মিতিতে বড় ভূমিকা নেয়। এ সময় তাঁর ছবিতে বহুদর্শীয় নির্লিপ্ততা ক্রমে স্থান করে নিতে থাকে। কিবরিয়া নিজেই পরিহাসের স্বরে বলেন, শেষ পর্যন্ত বৈষ্ণব চিন্তাই বুঝি পরিণতি। এ সময়কার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হলোÑ স্বাধীনতা, দিগন্ত, বসন্ত, অমর একুশে, ধূসর, সাদা প্রভৃতি। ২০০০ সালে আঁকা শিরোনামহীন দুটি প্রায় সাদা ছবি ফর্ম জ্যামিতিক যা কাঠামো বিষয়ে নিরুদ্বিগ্ন এক শিল্পীচিত্তের কথা বলে। কেবল টেক্সচারের হাত ধরে এসব শিল্প এক মার্গীয় মহিমা অর্জন করে। এ সময়ের তেল রং আর কাগজের কোলাজ ক্ষয় মনে করিয়ে দেয় ষাটের দশকের কিবরিয়ার লিথোগ্রাফের কথা। কিবরিয়ার ছেঁড়া কাগজ, পোড়ানো কাপড়, কিংবা মরচে ধরা টিন রং লাগানো ক্যানভাসের সঙ্গে চিত্রপিঠে সাময়িক ও স্থানিক দূরত্ব সৃষ্টি করে। মোহাম্মদ কিবরিয়া সব ধরনের দায়বদ্ধতার উর্ধে থেকে শিল্পচর্চা করেছেন। তাঁর কাজে আধুনিক নগরজীবনের নির্বেদ আর ক্লান্তিকে যতটা পাওয়া যায়, তারও বেশি পাওয়া যায় প্রকৃতির ভেতরের সুর আর স্পন্দন এবং মানুষের ওপর এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে। তাঁর ছবি মানে একটি আন্তঃক্রিয়াশীল ভাবনা, অনুভব, কল্পনার অঞ্চলও বটে। তাঁর শিল্প ও শিল্পভাবনা এক অনন্য সমৃদ্ধি আমাদের চিত্রশিল্পে। মাটির মানুষ, মাটির শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার রংতুলিময় কর্মকাণ্ড এ দেশের শিল্প জগতকে রাঙিয়ে রাখুক অনন্তকাল।
×