ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

যাঁদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

যাঁদের রক্তে  মুক্ত স্বদেশ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বেজে উঠত গান ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে/ইয়াহিয়া তোমায় আসামির মতো জবাব দিতেই হবে।’ মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর অতর্কিত হামলায় নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী হানাদাররা। তারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনক্সা তৈরি করেছিল। গণহত্যা শুরুর সেই রাতেই বেছে বেছে শিক্ষকদের হত্যা করা হয়। আর যুদ্ধে পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে তারা তালিকানুযায়ী শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, শিল্পীদের বাসা থেকে হাত ও চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হয়। কারও চোখ উপড়ে ফেলা হয়। কারও হাত কেটে ফেলা হয়। অর্ধ মৃতাবস্থায় তাদের গুলি করে, বেয়নেটে কুপিয়ে হত্যা করে বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়। এমনিতেই পুরো নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পরিকল্পিতভাবে দেশের জ্ঞানী গুণী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের হত্যা করা হয়। অনেকের লাশের আর হদিস মেলেনি। কারও কঙ্কাল মিলেছে। কারও বা গলিত শবদেহ। একাত্তরের ডিসেম্বরে যখন যুদ্ধের শেষ পর্যায় চলছিল, পাকিস্তানী হানাদারদের পরাজয় হয়ে ওঠেছিল অবশ্যম্ভাবী, তখন তারা স্বাধীনতার পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া নতুন দেশকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার জন্য লেলিয়ে দেয় তাদের সহযোগী বাঙালী নরাধমদের, রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামক বর্বর বাহিনী পাকিস্তানীদের নির্দেশ মেনে পুরো নয় মাস মুক্তিকামী বাঙালীদের হত্যায় পাশবিক উল্লাসে মেতেছিল। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করতে তাদের হাত কাঁপেনি, বিবেক বাঁধা দেয়নি। বরং অনেক আলবদর তাদের শিক্ষককে সন্তানদের সামনে নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। যারা আর ফেরত আসেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেকের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার, মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা সম্ভব হয়নি। পাওয়া যায়নি বহু লাশ। গায়ক সাদী মোহাম্মদের পিতা খলিলুল্লাহকে তার সামনেই কুপিয়ে হত্যা করে অবাঙালী খুনীরা। মোহাম্মদপুরে বসবাসরত বিহারীরা সেদিন বাঙালী নিধনে হত্যার ‘মহোৎসবে’ নেমেছিল বন্দুক, দা, কিরিচ, লোহার রড নিয়ে অনেক বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ২৬ মার্চ। এই বিহারীরা পরে আলশামস বাহিনী গঠন করে দেশজুড়ে বাঙালী হত্যা শুরু নয়, নারীদের নিপীড়ন, ঘর বাড়ি লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগও করে। এই বাহিনী ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর দখল করে রেখেছিল। বাঙালী সেনাদের সঙ্গে তাদের সশস্ত্র লড়াই হয়। সেখানেই এই আলশামস বাহিনীর গুলিতে নিহত হন বরেণ্য চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক জহির রায়হান। আর তাঁর অগ্রজ সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। যাঁর লাশ আর পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন ছেড়ে পৈত্রিক নিবাস সেন্ট্রাল রোডে চলে এসেছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে তাঁর প্রিয় ছাত্র আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রিয় শিক্ষকের কুশলাদি জানার জন্য সে বাড়িতে গিয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরী তখনও বিপদের আঁচ করেননি। বরং স্বাধীন হচ্ছে দেশ, তাতে উৎফুল্ল ছিলেন। কিন্তু পরদিন তাঁকেও বাসা থেকে পুত্র শিশুদের সামনে থেকেই ধরে নিয়ে যায় তাঁরই ছাত্র আলবদর তথা ইসলামী ছাত্রসংঘের ঘাতক দল। ওনার বড় পুত্র ভাষণ তখন রণাঙ্গনে হানাদার নিধনে ব্যস্ত। মিশুক তাঁর পিতার লাশ আর পায়নি। ইতিহাসের শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন আহমদকে মহসীন হলের ছাদ থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদররা। এভাবে ঘাতকরা আরও অনেক শিক্ষক, চিকিৎসককেও ধরে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। প্রতিটি ঘটনাই লোমহর্ষক। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। শহীদ হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের সন্তানদের চোখের জল, বুকের ব্যথা, যন্ত্রণা লাঘব হয়নি। সেদিনের শিশুরা বড় হয়ে জেনেছে তাদের পিতা, মাতাকে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পিতৃ হত্যার প্রতিশোধে তারা উন্মত্ত হয়নি। তবে হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে আসছিল। সেই দাবি পূরণ হচ্ছে। ঘাতকদের বিচার ও শাস্তিদান চলছে। যাঁদের রক্তেমুক্ত স্বদেশ, তাদের প্রতি যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে, তা শুনলে শিহরিত হতেই হয়। প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর আসে, আর শহীদ স্বজনদের বুকের মধ্যে দারুণ অগ্নিবান জ্বলজ্বল করে। বুদ্ধিজীবীর ঋণ অপরিশোধ্য। কিন্তু আমরা যেন দেশ মাতৃকার জন্য তাঁদের যে ঋণ, তা স্বীকার করি।
×