ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৭ আগস্ট ২০২৫, ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২

পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ঐতিহাসিক সাঁড়াঘাট এলাকায় দর্শনার্থীর ঢল 

 তৌহিদ আক্তার পান্না,ঈশ্বরদী, পাবনা

প্রকাশিত: ১৩:৩৩, ৭ আগস্ট ২০২৫

পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ঐতিহাসিক সাঁড়াঘাট এলাকায় দর্শনার্থীর ঢল 

ছবি: জনকণ্ঠ

ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং তার পাশেই নবনির্মিত লালন শাহ সেতু, পদ্মার ঢেউ আর সবুজে ঘেরা এক মন মুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শতবর্ষী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের গম্ভীর সৌন্দর্য আর আধুনিক স্থাপত্যের লালন শাহ সেতুর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় জমাচ্ছেন এই এলাকায়। বলা যায়, এটি এখন একটি অঘোষিত বেসরকারি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নৌকাভ্রমণ আর পদ্মার ঢেউ: পদ্মা নদীর টলটলে পানিতে নৌকা ভ্রমণের সুযোগ এখানে আসা পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। নদীতে ভেসে বেড়ানো ছোট ছোট নৌকাগুলোতে বসে নদীর ঢেউয়ের ছন্দ উপভোগ করা এক অসাধারণ অনুভূতি। ভরা মৌসুমে পদ্মার পানি যখন কুলকুল শব্দে বয়ে চলে, তখন সেই ঢেউয়ের অপরূপ দৃশ্য মন কেড়ে নেয়। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই ছুটে আসেন এখানে। 

দর্শনার্থীদের ভিড়কে কেন্দ্র করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে সারি সারি চটপটি, ফুচকা ও অন্যান্য খাবারের দোকান। এসব দোকানে পাওয়া যায় মুখরোচক বিভিন্ন খাবার, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া, কিছু ছোটখাটো দোকানও গড়ে উঠেছে যেখানে নানান ধরনের খেলনা ও স্যুভেনিয়ার বিক্রি করা হয়। এসব দোকানে কেনাকাটার সুযোগ থাকায় এটি হয়ে উঠেছে একটি পূর্ণাঙ্গ বিনোদন কেন্দ্র। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা: কেবল স্থানীয় লোকজন নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। এমনকি ঈশ্বরদী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত রাশিয়ানসহ অন্যান্য বিদেশি পর্যটকদেরও আনাগোনা দেখা যায়। এই অঘোষিত পর্যটন এলাকাটির আকর্ষণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পদ্মার পাড়ে সন্ধ্যা নামলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর আলো ঝলমলে রূপ এক অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি করে, যা সত্যিই ভোলার মতো নয়। 
এই মনোরম পরিবেশ, ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য প্রতিদিন ঈশ্বরদী ও পাকশীর সুনাম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পদ্মার হাওয়ায় মিশে থাকা এক অদ্ভুত ভালোবাসার ছন্দ, যা হৃদয়কে এক নির্মল শান্তি এনে দেয়। এই পরিবেশ সত্যি এক অন্যরকম অনুভূতি দেয়। এই স্থানটি কেবল একটি ভ্রমণ কেন্দ্র নয়, বরং এটি ঈশ্বরদী ও পাকশীর এক গর্বের প্রতীক।এখানেই শেষ নয়,

ঈশ্বরদীর ঐতিহাসিক সাঁড়া ঘাট আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যার ইতিহাস মূলত: হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণের সাথে সম্পর্কিত। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং সাঁড়া ঘাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বলতে সাঁড়া ঘাট একসময় পদ্মা নদীর অন্যতম প্রধান নদী বন্দর ছিল। ব্রিটিশ আমলের শুরু থেকেই এটি কলকাতা, উত্তরবঙ্গ, শিলিগুড়ি এবং আসামের সাথে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৮৭৮ সালে সাঁড়া থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথের সূচনা হয়। এই রেলপথটি নির্মিত হলে সাঁড়া ঘাট একটি বড় এবং কর্মচঞ্চল নদী বন্দরে পরিণত হয়। তখন এখানে প্রায় ১৬টি ঘাট ছিল, যেখানে বড় বড় স্টিমার, লঞ্চ, এবং মালবাহী নৌকা ভিড় করতো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাত্রী পরিবহনের সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৯ সালে পদ্মা নদীর উপর একটি রেল সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করে। এই সেতুর পরিকল্পনা এবং নির্মাণ সাঁড়া ঘাটের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু হওয়ার পর, সাঁড়া ঘাট এবং দামুকদিয়া ঘাটের মধ্যে নৌপথে ফেরি পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত পুরো রেললাইনটি ব্রডগেজ হয়ে যায় এবং সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর পর, পুরোনো রেললাইনটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং ঈশ্বরদী শহরকে প্রায় পাঁচ মাইল পূর্ব দিকে সরিয়ে নতুন রেললাইন স্থাপন করা হয়। এই সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিই ঘটায়নি, বরং এই অঞ্চলের অর্থনীতিতেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বর্তমানে সাঁড়া ঘাট হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে বেড়াতে আসা মানুষ পদ্মার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।

অন্যদিকে সারাঘাট, এক সময়কার পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশন এবং নদী বন্দর, তার সোনালি অতীত হারিয়ে গেলেও এখনও দর্শনার্থীদের কাছে এক আকর্ষণীয় স্থান। একসময় এই বন্দর দেশি-বিদেশি নাবিকদের আনাগোনায় মুখরিত ছিল, আর রেলপথে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করত। সেই জৌলুস এখন আর নেই, তবে এখনও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখানে ভিড় জমায়। এই বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান। এখানকার পেঁয়াজু, ফুচকা এবং চটপটি খুবই জনপ্রিয়। নদীর শান্ত বাতাস আর পদ্মা নদীর ঢেউয়ের মন মুগ্ধকর শব্দ দর্শনার্থীদের, বিশেষ করে তরুণদের আকর্ষণ করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই এলাকায় একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় এলাকার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা, মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র এবং মানব খুলি সহ চারজনকে আটক করেছে। আটককৃতদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন। এই ধরনের ঘটনা এখানকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য একটি বড় হুমকি। সারাঘাট তার পুরোনো ঐতিহ্য না হারালেও, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং দর্শনার্থীদের আকর্ষণ এখনও অমলিন। কিন্তু এই শান্তি বজায় রাখতে হলে অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
 

তাসমিম

×