
বৃক্ষের শরীরে এতো বোবা কাহিনীর কোনো স্বাক্ষর নেই জেনেও পূণর্বার হাত রাখে মায়মোনা। চোখ দুটি বোজা। বৃক্ষটি জীবনে একশ’ পয়ষট্টি মাতাল-সন্ধ্যার স্বাক্ষী ধরে রাখলেও মায়মোনার চরণ কোনো দিন এই পথে পা বাড়ায়নি। এখন বৃক্ষটিকে অনেক আপন মনে হওয়াতে তার ঘ্রাণ নিজের পোশাকের মতোই খুব পরিচিত লাগে। একটা দমকা হাওয়ার সাথে সকল দুঃখ-কষ্ট মিলিয়ে যায়। বেদনার কিছু সময় সে অনবিজ্ঞ নারী হিসেবে পার করে এসেছে। অভিজ্ঞতা তাকে পূর্ণ মানুষরূপে ভাবতে শিখিয়েছে। যদিও ওপথ ছিল দীর্ঘ ক্লান্তিকর।
২০১৭ সাল। বর্ষার সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল রাঙ্গামাটির ওপর। টানা একটি সপ্তাহ কয়েক সহস্র গ্যালন পানি খেয়ে পোয়াতী হয়েছিল মাটি।
অবশেষে অকালীন গর্ভপাত। সারা জনপদ জুড়ে অযুত লক্ষ টন মাটি ধসে পড়েছিল। ধসে পড়েছিল কাঁচা ঘরবাড়ী, অট্টালিকা, সেগুনের সারি, বাঁশঝাড়, উপাসনালয়, রাস্তাঘাট, হাট-বাজার।
চাপা পড়েছিল শত শত মানুষ। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন। অন্ধকার লোকালয়গুলো যেন একেকটা মৃত্যুপুরী। অথচ বর্ষণ থেমে নেই। আকাশটা যেন উল্টে দিয়েছে কেউ। ঝপ ঝপ করে নেমে আসছে পানি, আরও পানি, আরও…।
সেই চরম বিভীষিকাময় দিনগুলোতে জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে উদ্ধার-কাজে নেমেছিল কিছু ‘মানুষ’। উর্দি পড়া কিছু অকুতোভয় মানুষ।
মানিকছড়ি চেকপোষ্টের কাছে, আর এম এম কে রোডের মুখে বৃষ্টি, ঘাম আর চোখের জলে একাকার হয়ে, এক বুক থিকথিকে কাদার মধ্যে পাগলের মতো সার্চ করছিলো ওদের একটি দল। যদি এখনও কেউ বেঁচে থাকে, যদি রক্ষা করা যায় একটিও প্রাণ যার স্পন্দন এখনও ফুরিয়ে যায়নি!
হঠাৎ নিঃশব্দে নেমে এলো মৃত্যু। পাশের পাহাড় থেকে আরও একটি বিশাল মাটির চাঁই ধসে পড়ে নিমিষেই চাপা দিয়ে ফেললো পাঁচটি উর্দি পড়া টগবগে প্রাণ।
দূরের কোন শহরে তখন একচিলতে রোদ্দুর। ছাদে ডালের বড়ি শুকোতে দিতে দিতে কোন এক মায়ের বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো অজানা আশংকায়। খোকার ফোন আসছে না কদিন। কী যেন হচ্ছে ওখানে। নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। দুঃখিনী মা তো জানে না, খোকা চিরদিনের জন্য চলে গেছে নেটওয়ার্কের বাইরে।
সেবার থিকথিকে কাঁদামাটির নীচে চাপা পড়েছিল বনভূমি। চাপা পড়েছিল নানা প্রজাতির সহস্র বৃক্ষ। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে বিধাতা মানিকছড়ির ঐ স্পটে রোপণ করেছিলেন দুষ্প্রাপ্য এক বৃক্ষের পাঁচটি বীজ। বৃক্ষের নাম ‘মানবতা’।
২০২৪ সাল। পুরো ফেনী ডুবে গেছে বানের জলে। উঁচু ঘরবাড়িগুলোর ছাদে পানিবন্দী হয়ে আছে অসংখ্য মানুষ। বিরা ভেসে গেছে সমুদ্রে। বিদ্যুৎ নেই, নেটওয়ার্ক নেই, খাবার নেই, পানি নেই। এক বুক তৃষ্ণা, একপেট ক্ষুধা, আর সীমাহীন আতঙ্ক নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে লাখ লাখ মানুষ।
চট্টগ্রাম থেকে বোটভর্তি ত্রাণ নিয়ে ফেনীর পথে ছুটে চললো একদল যুবক। কোনো প্রশিক্ষণ নেই, অভিজ্ঞতা নেই। আছে শুধু সীমাহীন সাহস আর পুরো বুক জুড়ে বিশাল একেকটা হৃদয়।
পানিতে একাকার হয়ে গেছে সমুদ্র, নদী, খাল, রাস্তাঘাট। মীরসরাই এর পর থেকেই নেটওয়ার্ক বন্ধ। তুমুল বৃষ্টি। তীব্র স্রোত। নিকষ কালো আধার চারদিকে। দিক হারালো ওরা। নিজেদের অজান্তেই তীব্র স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে থাকলো সমুদ্রের গভীরে। আর ফিরলো না।
এক সময় বানের পানি নামতে শুরু করলো। জেগে উঠল সমুদ্রতট। কেউ জানলো না, অনুর্বর বালুতটে পরম যত্নে বিধাতা রোণে করে গেছেন দুষ্প্রাপ্য এক বৃক্ষের আটটি বীজ। বৃক্ষের নাম ‘মানবতা’।
২০২৫ সাল। মাইলষ্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ২১ জুলাই। দুপুর একটা বেজে কয়েক মিনিট। হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে এলো মৃত্যুদূত। নিমিষেই কয়েকটি শ্রেণীকক্ষে জ্বলে উঠল আগুন। তাপমাত্রা কয়েক হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। ভেতরে সব ছোট ছোট্ট বাচ্চা। চেনা পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃসাহসী মানুষটিরও অতো বড় কলিজা নেই যে, ঐ নিশ্চিত মৃত্যুর আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার-কাজ চালায়।
পুরো পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে আমাদের চিরচেনা জগতের ওপার থেকে যেন আবির্ভূত হলেন তিনজন মহীয়ষী নারী- মাহরীন, মাসুকা, মাহফুজা। ঐ তীব্র আগুনের তাপ উপেক্ষা করে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তারা। একে একে বের করে আনলেন বিশটি বাচ্চা। এরমধ্যে পুড়ে নিঃশেষ হলেন নিজেরা। দু’জন চলে গেছেন ওপারে। একজন এখনও অবস্থান করছেন এপার আর ওপারের মাঝামাঝি।
বিধাতা বিভিন্ন সময়ে যে মানবতা বৃক্ষগুলো রোপণ করেছিলেন, তার মধ্যে থেকে দুটি পুরোপুরি ম্যাচিওরড হয়ে গিয়েছিল। তাই কাঠুরে-বিধাতা ঐ দুটিকে কেটে নিয়ে গেলেন স্বর্গে। বিনিময়ে ঐ ছাইয়ের স্তূপে নতুন করে রোপণ করলেন আরও বিশটি বীজ।
একদিন এই বীজগুলোও অঙ্কুরিত হবে। জন্ম নেবে আরও আরও মানবতা বৃক্ষ। যুগ যুগ ধরে ওরা আমাদের অন্ধকার মনোঃজগতে আলো ছড়াবে। এভাবেই বিধাতা অন্ধকারের উপর আলোকে ছুড়ে দেন। বীজ লাগবে কারও, বীজ? মানবতার বীজ।
রাজু