ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রতিশ্রুতির স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে জনজীবন

জলজটে ভোগান্তি ডেমরাবাসীর

নিজস্ব সংবাদদাতা, ডেমরা, ঢাকা

প্রকাশিত: ০১:০৮, ১ আগস্ট ২০২৫

জলজটে ভোগান্তি ডেমরাবাসীর

রাজধানীর ফরিদাবাদের হরিচরণ রায় সড়কে ড্রেনেজ সংস্কার কাজে ধীরগতি। বাসিন্ধারা ভোগান্তিতে

রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল এলাকা ডেমরা। অথচ এখানে সামান্য বৃষ্টিই যেন ভয়াবহ দুর্যোগ বয়ে আনে। দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতা একটি পুরানো সমস্যা হলেও এখনো এর কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। খাল ভরাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থার অবনতি, অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ, খাল দখল, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও নাগরিক সচেতনতার অভাব-সব মিলিয়ে ডেমরা যেন জলাবদ্ধ শহরের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ডিএসসিসির ৬৪, ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভুট্টু চত্বর, কোনাপাড়া, কদমতলা মোড়, ফার্মের মোড়, মোমেনবাগ চৌরাস্তা ও আশপাশের অভ্যন্তরীণ সড়কজুড়ে বৃষ্টির পানি জমে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। ৬৭ ও ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডে বক্সনগর, মহাকাশ রোড, বড়ভাঙ্গা, টেংরা, কোদাল দোয়া, গ্রীন সিটি, ডগাইর মধ্যপাড়া, নতুন পাড়া, বামৈল, সানারপাড়, মধ্য ও পশ্চিম হাজীনগর-সব জায়গাতেই একই অবস্থা। ৬৯ ও ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের আমুলিয়া, খলাপাড়া, মেন্দিপুর, নলছাটা, ধিৎপুর, ঠুলঠুলিয়া, বাইগদিয়া, মানিকদিয়া, কুসুমবাগ, বেগুনবাড়ী ও দেবধোলাই খাল সংলগ্ন নিচু এলাকাগুলোতেও একইভাবে পানি জমে রয়েছে।
চলমান বর্ষণে এসব এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়ক ও নিম্নভূমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বাজার, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, এমনকি স্কুলের মাঠ ডুবে যাওয়ায় জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। দূষিত পয়ঃনিষ্কাশনের পানি ঢুকে পড়েছে বাড়ির ভেতর, রান্নাঘর, উঠান, এমনকি খাটের নিচেও। ফলে শৌচাগার ব্যবহার ব্যাহত হচ্ছে এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম হয়ে পড়েছে কষ্টসাধ্য। অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট।
জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও খেটে খাওয়া মানুষ। প্রতিদিন হাঁটুপানি মাড়িয়ে স্কুলে যেতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বইপত্র ভিজে নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে পানিতে ঢেকে থাকা গর্ত ও ভাঙা রাস্তা চোখে না পড়ায় রিক্সা ও মোটরসাইকেল উল্টে পড়ার ঘটনা ঘটছে, যা শিশু ও বৃদ্ধদের চলাচলে চরম বিপত্তি সৃষ্টি করছে। যানবাহনের সংকট ও ঝুঁকি থাকায় অটোরিক্সা ও ইজিবাইক চালকরা তিন থেকে চার গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছেন, যা নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ড্রেনগুলো দীর্ঘদিন অপরিষ্কার থাকায় ময়লা, পলিথিন, প্লাস্টিক ও বর্জ্য জমে গিয়ে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন না হয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় জমে থাকে। ডিএনডি এলাকার অধিকাংশ খালই এখন কচুরিপানা ও আবর্জনায় পূর্ণ। খালপাড়ে গড়ে ওঠা অস্থায়ী দোকান থেকে নিয়মিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, যা পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে। এর ফলে নিচু জমি, কৃষি জমি ও মাছের খামার পানিতে তলিয়ে গিয়ে কৃষক ও খামারিরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। 
জলাবদ্ধতা শুধু দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ভোগান্তি সৃষ্টি করছে না, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্যও এক বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানিতে জন্ম নিচ্ছে রোগবাহী মশা। ফলে ডেমরায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, ডেমরার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫ জন রোগী চর্ম ও পেটের রোগ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন, যার মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
ডেমরাবাসীর অভিযোগ, জলাবদ্ধতা কেবল প্রাকৃতিক নয়, বরং অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক উদাসীনতার ফল। তারা দাবি করছেন, অভ্যন্তরীণ খালগুলো থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, খালের তলদেশ থেকে পলি ও আবর্জনা সরানো এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়া খালে বাসিন্দাদের দ্বারা আবর্জনা ফেলা রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও প্রশাসনিক নজরদারির দাবি জানান তারা। দ্রুত পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ কাঁচা সড়ক উন্নয়ন, বিশেষ করে স্কুল সংলগ্ন রাস্তাগুলোর সংস্কারও এলাকাবাসীর অন্যতম দাবি। তারা বলেন, ডিএসসিসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সমে খাল খনন ও ড্রেন সংস্কারের প্রতিশ্রুতি এলেও কাজের বাস্তব অগ্রগতি নেই।

প্যানেল হু

×