
ছবি: সংগৃহীত
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার গ্রামবাংলার শস্যশোভিত মাঠে এখন ছড়াচ্ছে লাউয়ের ডগার সবুজ রং আর টাটকা ঘ্রাণ। বিশেষ করে চান্দেরচর, খাসকান্দি, মদিনাপাড়া, বালুচর—এইসব এলাকায় লাউয়ের চাষ যেন এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। কেউ করছেন জমিতে খুঁটি পুঁতে বাণিজ্যিক চাষ, আবার কেউ বাড়ির আঙিনা কিংবা ঘাটের পাশে বাঁশের ঝাঁকা দিয়ে ঘরোয়া ব্যবস্থায়। বর্ষা এসেছে। আকাশে-মাটিতে জল, মাঠে পানি—তবুও থেমে নেই লাউয়ের ডগা চাষ। বরং এই সময়ে ঢাকার বাজারে লাউয়ের ডগার চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কারণ, বর্ষায় অন্যান্য শাকসবজি কম থাকায় ক্রেতারা বেশি ঝুঁকছেন এই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু শাকটির দিকে।
লাউ মূলত শীতকালীন সবজি হলেও এর ডগার জনপ্রিয়তা এখন মৌসুমি সীমার বাইরে। বছরের অনেকটা সময় জুড়ে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে লাউয়ের ডগা, আর চাহিদা যেন দিনে দিনে বাড়ছে। ঢাকার শ্যামবাজার, জয়কালী মন্দির কাঁচাবাজার, কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের অনেক কাঁচাবাজারে সিরাজদিখানের লাউয়ের ডগা সরবরাহ হচ্ছে নিয়মিত।
প্রতিদিন ভোরে বালুচরসহ আশপাশের এলাকার কৃষকরা জমি থেকে কেটে নিচ্ছেন লাউয়ের ডগা। ৪টি ডগা বেঁধে বানানো হয় একটি সেট, যা পাইকারি দরে বিক্রি হয় ৩০ টাকায়। ঢাকার বাজারে এই সেটই আবার খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে। পাইকারদের ভাষায়, “এক কুড়ি (২০ সেট) ডগা বিক্রি হয় প্রায় ৭০০ টাকায়। এতে কৃষক যেমন লাভবান, আমরাও কিছুটা মুনাফা করতে পারি।”
লাউ চাষের আদর্শ সময় বসন্তকাল—মার্চ থেকে এপ্রিল। তবে আগাম চাষ করতে চাইলে জানুয়ারিতেই চারা রোপণ করা যায়। জুন-জুলাইতেও বর্ষা মৌসুমে কিছু কিছু এলাকায় লাউ চাষ হয়, তবে সেটি তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও পানির জমে থাকা রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বাড়ায়।
লাউ চাষ শুধু ফল বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই সবজির প্রায় প্রতিটি অংশ বাজারে বিক্রিযোগ্য। লাউয়ের ডগা (শাক) জনপ্রিয় পুষ্টিকর সবজি হিসেবে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন। লাউ পাতা অনেকে তরকারি বা ভর্তা হিসেবে ব্যবহার করেন, আর পরিপক্ব লাউ সবজির বাজারে প্রধান পণ্য। বীজ সংরক্ষণ ও বিক্রয়যোগ্য। লতার শুকনো অংশ কখনো কখনো জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়।
স্থানীয় কৃষক জসিম শেখ বলেন, “আমি মদিনাপাড়া এলাকায় ৪ কাঠা জমিতে লাউ চাষ করছি। ডগা কেটে কেটে এক মাসেই ১০-১২ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। এখনো লাউ উঠেনি, কিন্তু ডগার টাকাতেই খরচ উঠে গেছে।”
এই অঞ্চলে লাউয়ের ডগা সংগ্রহ ও বান্ডিল তৈরির কাজেও নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বাড়ির আশপাশে লাউ চাষ করে গৃহিণীরাও আয় করছেন প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা।
ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলোতেও এখন নিয়মিত লাউয়ের ডগা ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন রান্নায়। পুঁই শাকের বিকল্প হিসেবে অনেকে এটি বেছে নিচ্ছেন। ফলে এই ডগা এখন আর গ্রামবাংলার অগোচরে থাকা শাক নয়—এটি শহুরে খাদ্যতালিকায়ও জায়গা করে নিচ্ছে দৃপ্ত ভঙ্গিতে।
সিরাজদিখানের কৃষকরা লাউয়ের ডগাকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। সঠিক পরিচর্যা, সেচ ও সময়মতো কাটার মাধ্যমে তারা প্রতি গাছে বারবার ডগা তুলতে পারছেন—যা শহরে পৌঁছে দিচ্ছে পুষ্টি, আর কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছে মুনাফার হাসি। লাউয়ের এই সবুজ বিপ্লব হয়তো একদিন আরও বড় পরিসরে দেশের অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়বে।
মুমু ২