
রক্তঝরা জুলাই
সরকারি চাকরিতে কোটা-পদ্ধতি বাতিলের আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তার দলীয় নেতাকর্মী ও প্রশাসনকে নিয়ে আন্দোলন বন্ধ করার নানা পাঁয়তারা শুরু করতে থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালসহ মোট চার দফা দাবিতে ২০২৪ সালের ৪ জুলাই চতুর্থ দিনের মতো দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ৪ জুলাই সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
দেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলে। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, তাদের সকল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন তারা। গতকয়েকদিনের মতো এদিনও শাহবাগ মোড়ের আন্দোলনে যোগ দিতে বের হতে গেলে বাধার সম্মুখীন হন। ঢাবির সূর্য সেন হল, কবি জসীমউদ্দীন হল ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। শুধু ঢাবিতে নয় এদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা দেয় বলে অভিযোগ জানান শিক্ষার্থীরা।
সব বাধা পেরিয়ে বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করে। পরে তারা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়, যা চলে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। এদিন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে অংশ নেয়। এদিন শাবিপ্রবিতেও বেলা ১১টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীও আন্দোলনে শামিল হন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মিলে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে অবস্থান নেন।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এই কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তারা সকাল ১০টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান রাখেন। এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক ঘণ্টা ধরে বন্ধ রাখেন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কও। ওদিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বন্ধ থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও। এ ছাড়া ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বন্ধ থাকে সায়েন্সল্যাব ও নীলক্ষেত এলাকা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের শিক্ষার্থীরা তাঁতিবাজারে এলাকায়, শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকার আগারগাঁও-এ আন্দোলন করে।
এদিকে সাবেক প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ছাত্রজনতাকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। এদিন প্রধান বিচারপতি ওবাইদুল হাসান বলেন, এতো কিসের আন্দোলন? সুপ্রিম হাইকোর্ট কি আন্দোলন দেখে বিচার করবে? অন্যদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় ৩ জন আহত হওয়ার ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে তা চলমান পরিস্থিতিকে আর ঘোলাটে করে তোলে। তখন শিক্ষার্থীদের একটিই দাবি ‘কোটা প্রথা বাতিল চায় তারা’ কোটা বাতিল না করে ঘরে ফিরবেন না তারা।
একই দিন শাহবাগ মোড়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। কর্মসূচিতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ৫ জুলাই দেশব্যাপী অনলাইন ও অফলাইন প্রচার এবং ৭ জুলাই দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি চলমান থাকবে যতদিন না আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে। এর পর কর্মসূচি ঘোষণা শেষে সবাই নিজের গন্তব্যে ফেরেন। তবে মধ্যরাতে আবার হঠাৎ উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাবির হলপ্রাঙ্গণ ।
কেননা, কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমকে হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এঘটনার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক অমর একুশে হলের সামনে জড়ো হন প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী। পরে হল প্রভোস্ট এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এদিনের পর থেকেই তীব্র আন্দোলন হতে শুরু করে দেশজুড়ে।