ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

অশিক্ষিতরা বেকার নয়, শিক্ষিতরাই বেকার!

সজীবুল ইসলাম সজীব, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পাটগ্রাম, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৮ জুন ২০২৫

অশিক্ষিতরা বেকার নয়, শিক্ষিতরাই বেকার!

ছবি: সংগৃহীত।

কর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা। এজন্য দিন দিন শিক্ষিত ও তরুণ বেকারের চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার আশঙ্কাজনক। ফলে সম্ভাবনাময় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে হতাশা এবং দেশ বঞ্চিত হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির সুবিধা থেকে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) বিভিন্ন সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি সম্পদের অপচয় হচ্ছে। ফলে দক্ষতা বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার মান বাড়িয়ে বাস্তব কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করার এখনই সময়।

আমাদের সমাজে এক অদ্ভুত বাস্তবতা দৃশ্যমান—অশিক্ষিত মানুষের তুলনায় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারত্বের হার বেশি। শুনতে বিস্ময়কর মনে হলেও বাস্তবে এই চিত্রটাই অধিক সত্য। শহর কিংবা গ্রাম—সব জায়গায়ই দেখা যায়, যাদের কোনো ডিগ্রি নেই, লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, তারা জীবনের প্রয়োজনেই কাজের সন্ধানে নেমে পড়ে। দিনমজুরি, রিকশা চালানো, কৃষিকাজ, ছোটখাটো ব্যবসা—তারা যেটাই হোক না কেন, কোনো না কোনোভাবে জীবিকার ব্যবস্থা করে নেয়। অথচ আমাদের দেশে হাজারো স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী যুবক বেকারত্বের বোঝা টেনে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই বৈপরীত্য? কেন শিক্ষিতরাই অধিক বেকার?

এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ—

১. অতিরিক্ত প্রত্যাশা ও সামাজিক মানদণ্ড।
শিক্ষিত যুবক মনে করে, তাকে অবশ্যই একটি সম্মানজনক চাকরি করতে হবে, যাতে টেবিল, চেয়ার, এয়ার কন্ডিশন আর মাস শেষে বেতন থাকে। অথচ বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। সেই চাকরি হয়তো মেলে না, কিংবা সুযোগ পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। তখন সে অপেক্ষার বৃত্তেই আটকে পড়ে।

২. স্বকর্মে অনাগ্রহ।
যে কাজ একজন অশিক্ষিত মানুষ আনন্দের সাথে করছে, সেটি একজন শিক্ষিত যুবক "অসম্মানজনক" বলে এড়িয়ে চলে। ফলে তার আয়-রোজগারের পথ আরও সংকুচিত হয়ে পড়ে। অথচ স্বনির্ভর হওয়ার মানসিকতা থাকলে একজন শিক্ষিত মানুষ নিজেই হতে পারে একজন উদ্যোক্তা।

৩. কারিগরি দক্ষতার অভাব।
আজকের বাজার চাহিদা শুধু ডিগ্রির ওপর নির্ভর করে না। প্রয়োজন দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ও প্রযুক্তির ব্যবহারিক জ্ঞান। অনেক শিক্ষিত যুবকের এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

৪. ব্যবস্থা ও নীতির অসংগতি।
শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে শ্রমবাজারের চাহিদার মিল না থাকার কারণেও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক সময় বাস্তবজ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তির চর্চা না করে শুধু সনদপত্রে সীমাবদ্ধ থাকে।

৫. অশিক্ষিতদের বাস্তব জীবনে দ্রুত অভিযোজন।
অশিক্ষিত মানুষ জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় ছোটবেলা থেকেই। তাই তারা দ্রুত কাজ শিখে নেয়, ব্যবসা বোঝে, কষ্ট সহ্য করতে জানে এবং কম খরচে জীবনযাপন করে—যা তাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে।

আজকের বাস্তবতায় শুধু ডিগ্রি নয়, প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি, আত্মনির্ভরতা এবং যুগোপযোগী দক্ষতা। আমাদের শিক্ষিত সমাজকে বুঝতে হবে—কাজ কখনো ছোট নয়। বেকার থাকার চেয়ে স্বনির্ভর হওয়া অনেক সম্মানজনক। জীবন বাঁচাতে হলে কাজ করতে হবে—হোক সেটা চাকরি, ব্যবসা, বা সৃজনশীল কোনো উদ্যোগ।

তাই হ্যাঁ, সমাজের চিত্র বলছে, অশিক্ষিতরা বেকার নয়। কারণ তারা অপেক্ষা করে না, কাজকে ছোট করে না। আর শিক্ষিতরাই বেকার, কারণ তারা শুধু চাকরির আশায় সময় নষ্ট করে—স্বপ্ন দেখে, পদচ্যুত হয়, হতাশ হয়। বদলাতে হবে এই মানসিকতা—তবেই মিলবে বেকারমুক্ত শিক্ষিত সমাজ।

"ডিগ্রির ভারে নয়, দক্ষতার জোরেই গড়ে ওঠে জীবন। চাকরি না পেলে নিজেই কিছু শুরু করুন।"

মিরাজ খান

×