
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস
আজ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৮৫ তম জন্মদিন।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী দুলা মিয়া সওদাগর। তিনি পেশায় একজন জহুরি ছিলেন এবং মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। দুই ভাই ও নয় বোনের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন তৃতীয়। মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং ছোট ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একজন জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব। মুহাম্মদ ইউনূসের সহধর্মিনীর নাম ড. আফরোজী ইউনুস। দুই কন্যার জনক মুহাম্মদ ইউনূস এর এক মেয়ের নাম মনিকা ইউনূস এবং অন্য জনের নাম দীনা আফরোজ ইউনূস।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। কলেজে তিনি নাটকে অভিনয় করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা এবং আজাদী পত্রিকায় কলাম লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্স -এ যোগ দেন গবেষণা সহকারী হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস সবসময় দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনুস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।
পরবর্তীতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন গরিব বাংলাদেশীদের মধ্যে ঋণ দেবার জন্য। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরিবকে রক্ষা করার জন্য ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্রঋণের সাথে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস খামাড় এবং সেচ ঋণ প্রকল্প সহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যাবস্থা। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব এমন কি যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহকে গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্ভুদ্ধ হয়।
২০০৬ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে তার অসামান্য অবদানের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল কমিটি তাদের ঘোষণায় উল্লেখ করে, “দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের মতো একটি উদ্ভাবনী ধারণার জন্য এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁদের প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার দেওয়া হলো।” প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার ছাড়াও ড. মোহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬২টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০ টি দেশ থেকে বিশেষ সম্মাননা সহ সর্বমোট ২৬ টি দেশ থেকে ১১২ টি পুরষ্কার লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোন দলীয় রাজনীতি করেন নি। তবে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার মাত্র ৫ মাসের মধ্যে তিনি নাগরিক শক্তি নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন। তবে ২০০৭ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। সেবার তিনি এই প্রস্তাবটিও নাকচ করে দেন।
২০২৪ সালে ছাত্রজনতার আন্দোলনের তোপের মুখে বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হলে, বাংলাদেশের ছাত্রজনতা এবং সকল দলের সর্বসম্মতিক্রমে ৬ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ পাঠ করানো হয়।
তিনি অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই একের পর এক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবন এক চলমান অনুপ্রেরণার নাম। দারিদ্র্যজয়ের নায়ক থেকে শুরু করে সামাজিক ব্যবসার প্রবর্তক এবং এখন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক।তার দূরদর্শী পথচলা প্রমাণ করে তিনি এমন একজন মানুষ তার সততা, প্রজ্ঞা ও কর্ম দিয়ে কতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেন।
জন্মদিনে এই মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ও রাষ্ট্রনায়কের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।
তাসমিম