
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।
বাংলাদেশের শহুরে জীবনযাত্রায় এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রবেশ এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই বাহনগুলো একদিকে যেমন অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তেমনি অন্যদিকে নাগরিকদের যাতায়াত ব্যবস্থায় এনেছে এক নতুন মাত্রা। কিন্তু এই "বিপ্লব" শব্দটির পেছনে লুকিয়ে আছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা—ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা, অদক্ষ চালকের বিশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির এক উদ্বেগময় চিত্র। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যাটারিচালিত রিকশা বা অটোরিকশার সঙ্গে জড়িত। এই পরিসংখ্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, শহরের অলিগলি থেকে গ্রামের মেঠোপথ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া এই বাহনগুলো এখন কেবল সহজলভ্য পরিবহন নয়, বরং এক একটি চলমান দুর্যোগে পরিণত হয়েছে।
এই সমস্যা সামনে এলেই আমাদের মধ্যে দুটি সরল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। প্রথমটি হলো, কঠোর হস্তে এগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবি। দ্বিতীয়টি হলো, চালকদের প্রশিক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের মতো গতানুগতিক সমাধানের কথা বলা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দুটি পথই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। উচ্চ আদালত একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা আরোপের নির্দেশ দিলেও জীবিকার প্রশ্নে চালকদের প্রতিরোধ এবং যাত্রীদের চাহিদার কারণে তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ হলো, আমরা সমস্যাটিকে কেবল একটি যান বা তার চালকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেখছি। আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি না যে, এই অর্ধকোটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের নগর পরিকল্পনা, গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থান নীতির ব্যর্থতার এক রূঢ় প্রকাশ।
বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখা প্রয়োজন। এই রিকশাগুলো কেন এত জনপ্রিয়? কারণ, এগুলো আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থার শূন্যস্থান পূরণ করছে। যেখানে বাস যায় না, সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া সাধারণের নাগালের বাইরে, সেখানে এই রিকশাগুলোই শেষ ভরসা। একজন দিনমজুর বা পোশাকশ্রমিক স্বল্প খরচে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য কিংবা একজন গৃহিণী কাছাকাছি বাজারে যাওয়ার জন্য এই বাহনটির ওপরই নির্ভরশীল। অন্যদিকে, গ্রাম থেকে শহরে আসা একজন কর্মহীন যুবকের জন্য এই রিকশাটিই আত্মকর্মসংস্থানের সবচেয়ে সহজ উপায়। সুতরাং, একে কেবল উৎখাতের দৃষ্টিতে দেখলে আমরা একাধারে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা এবং কোটি মানুষের যাতায়াতের মাধ্যমকে অস্বীকার করব। সমাধান তাই নির্মূলে নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল করার মধ্যেই নিহিত।
এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। প্রথমত, এই বাহনগুলোকে রাস্তায় নামানোর আগে সেগুলোর কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে যেভাবে ভাঙাচোরা প্যাডেল রিকশার সঙ্গে মোটর ও ব্যাটারি জুড়ে দিয়ে রাস্তায় নামানো হচ্ছে, তা আত্মহত্যার শামিল। সরকারের উচিত, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বা অন্যান্য কারিগরি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় একটি নির্দিষ্ট ও নিরাপদ নকশা প্রণয়ন করা। এই নকশা অনুযায়ী নির্মিত রিকশা ছাড়া অন্য কোনো রিকশাকে রাস্তায় চলার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। স্থানীয় পর্যায়ে ওয়ার্কশপগুলোকে এই নকশা অনুযায়ী রিকশা তৈরি বা রূপান্তরে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে একটি নতুন শিল্প খাতও তৈরি হবে।
দ্বিতীয়ত, চালকদের শুধুমাত্র প্রশিক্ষণের কথা না বলে তাদের নিবন্ধন এবং লাইসেন্সিংকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে। প্রতিটি রিকশা এবং চালকের জন্য একটি ইউনিক আইডি নম্বর থাকবে, যা কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এলাকাভিত্তিক চলাচলের অনুমতি বা জোনিং ব্যবস্থা। যেমন, এই রিকশাগুলোকে প্রধান সড়ক বা মহাসড়কে চলতে না দিয়ে শুধুমাত্র সংযোগ সড়ক বা আবাসিক এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে। এতে যানজট যেমন কমবে, তেমনই বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলো এই জোনিং ব্যবস্থা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে।
সবশেষে, আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, ব্যাটারিচালিত রিকশার এই দৌরাত্ম্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হলো একটি কার্যকর ও জনবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। যতদিন পর্যন্ত আমরা সাশ্রয়ী, নিরাপদ এবং পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত এই ধরনের বিকল্প পরিবহনের চাহিদা থেকেই যাবে। সুতরাং, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরের জন্য একটি শক্তিশালী বাস নেটওয়ার্ক, মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ এবং পরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যখন একজন নাগরিক জানবে যে, তিনি স্বল্প সময়ে ও খরচে বাসে বা ট্রেনে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ বাহন এড়িয়ে চলবেন।
ব্যাটারিচালিত রিকশা আজ আমাদের জন্য একটি মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্যাকেই সম্ভাবনায় রূপান্তর করা সম্ভব। একে উচ্ছেদ করার মরিয়া চেষ্টা না করে, বরং আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে একে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল করার পথেই হাঁটতে হবে। এটি শুধু সড়ককে নিরাপদ করবে না, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা রক্ষা করবে এবং আমাদের নগর জীবনকে আরও কিছুটা স্বস্তিদায়ক করে তুলবে। সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এই চলমান দুর্যোগকে একটি নিয়ন্ত্রিত সেবায় পরিণত করাই এখন সময়ের দাবি।
মিরাজ খান