ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

কঙ্গো-রুয়ান্ডা সংঘাতের অবসানে শান্তিচুক্তি: যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা, নিজেদের স্বার্থ কতটা?

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ২৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৮:১৮, ২৮ জুন ২০২৫

কঙ্গো-রুয়ান্ডা সংঘাতের অবসানে শান্তিচুক্তি: যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা, নিজেদের স্বার্থ কতটা?

ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ কয়েক দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে মধ্য আফ্রিকার দুই প্রতিবেশী দেশ কঙ্গো ও রুয়ান্ডা। মার্কিন সরকারের ভাষ্যে, এই চুক্তি কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব কঙ্গোতে শান্তি ফিরিয়ে আনবে না, একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও তার কোম্পানিগুলোকে অঞ্চলটির গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রবেশাধিকারও দেবে।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর হোয়াইট হাউসে এক অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আজকের দিনটি এক নতুন ভোর। সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের অবসান ঘটিয়ে এই অঞ্চল আশার, সমৃদ্ধির ও শান্তির নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একে ‘৩০ বছরের যুদ্ধের অবসানে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ

১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া সংঘাত এখন পর্যন্ত ৬০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ নিয়েছে। কঙ্গোর শতাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী M23, যাদের পক্ষে রুয়ান্ডার সমর্থন রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও শান্তিচুক্তিটিকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, বিশ্লেষকরা বলছেন, কঙ্গোর সবচেয়ে ক্ষমতাধর বিদ্রোহী গোষ্ঠী M23 সরাসরি চুক্তির আওতাভুক্ত নয়, ফলে তাৎক্ষণিকভাবে সংঘাতের অবসান সম্ভব নয়।

শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে চুক্তি

চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন কঙ্গোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেস কায়িকওয়াম্বা ও রুয়ান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অলিভিয়ে এনডুহুংগিরেহে। তারা শান্তির আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেন।

‘কিছু ক্ষত নিরাময় হবে, কিন্তু সবটা নয়’, বলেন কায়িকওয়াম্বা। ‘যারা সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন, তারা আজ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমরা যেন তাদের আশাভঙ্গ না করি।’

রুয়ান্ডার মন্ত্রী এনডুহুংগিরেহে বলেন, ‘আগামীর পথ মসৃণ হবে না, তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ অংশীদারদের সহায়তায় আমরা মনে করি, আজ একটি মোড় ঘুরেছে।’

তারা যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কাতারের মধ্যস্থতাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। উল্লেখ্য, কাতার গত কয়েক মাস ধরে এই চুক্তির বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করেছে।

চুক্তিতে রয়েছে—সীমান্ত অখণ্ডতা বজায় রাখা, যুদ্ধবিরোধ, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিরস্ত্রীকরণ ও শর্তসাপেক্ষে পুনঃসমন্বয়ের শর্তাবলি।

বিদ্রোহীদের প্রতিক্রিয়া ও বাস্তবতা

সবচেয়ে আলোচিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী M23 এই চুক্তিকে মান্যতা দেয়নি। তাদের জোট ‘AFC’-এর নেতা করনেইল নাঙ্গা বলেন, কঙ্গো সরকার যতক্ষণ না তাদের দাবিদাওয়াকে স্বীকার করছে, ততক্ষণ শান্তি আলোচনা অর্থহীন। M23 মুখপাত্র অস্কার বালিন্ডাও বলেন, এই চুক্তিতে তাদের অংশ না থাকায় তা তাদের ওপর প্রযোজ্য নয়।

এ প্রসঙ্গে রুয়ান্ডার মন্ত্রী জানান, কাতারে আলাদা করে কঙ্গো ও M23-এর মধ্যকার আলোচনাও চলছে, যা হয়তো ভবিষ্যতে শান্তি নিয়ে আরও অগ্রগতি আনবে।

খনিজ সম্পদ ও ভূরাজনীতি

পূর্ব কঙ্গোর যে খনিজ সম্পদ (যেমন: কোবাল্ট, ট্যানটালাম) স্মার্টফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত নানা প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য, তা নিয়ে বড় কূটনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে চীনা কোম্পানিগুলো এ খাতে সক্রিয়। ট্রাম্প প্রশাসন এই অঞ্চল থেকে খনিজ আহরণে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে চায়। মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, কঙ্গোর ভূগর্ভস্থ সম্পদের মূল্য প্রায় ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিশ্চিয়ান মোলেকা এই চুক্তিকে ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’ বলে অভিহিত করলেও সতর্ক করে বলেন, ‘এটি ভুক্তভোগী ও আক্রমণকারীর মধ্যে জোরপূর্বক এক ধরনের অংশীদারিত্ব চাপিয়ে দিয়েছে, যেখানে ন্যায়বিচারের কোনও সুর নেই।’

কঙ্গোর সংঘাতপীড়িত নর্থ কিভু প্রদেশের মানবাধিকার কর্মী হোপ মুহিনুকা বলেন, ‘আমার মনে হয় না আমেরিকানদের পুরোপুরি বিশ্বাস করা উচিত। আমাদের নিজেদেরই এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’

ইতিহাসের পেছনে রক্তপাতের ছায়া

এই সংঘাতের মূল সূত্রপাত ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার পর, যেখানে অন্তত ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ তুতসি ও সহনশীল হুতু জনগণ নিহত হন। তুতসি-নিয়ন্ত্রিত বাহিনী পাল্টা প্রতিরোধ শুরু করলে প্রায় ২০ লাখ হুতু কঙ্গোতে পালিয়ে যায়। রুয়ান্ডা দাবি করে, তাদের মধ্যে অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল এবং কঙ্গোর সেনাবাহিনীর কিছু অংশ তাদের রক্ষা করছে—যা বর্তমান সংঘাতের মূলে রয়েছে।

এই শান্তিচুক্তি সংঘাতের অবসানে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, একে কার্যকর করতে গেলে শুধু সামরিক নয়, ন্যায়বিচার, আস্থা ও আঞ্চলিক সমন্বয়ও অপরিহার্য বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

 

সূত্র: এপি।

রাকিব

×