
জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি ফু কং, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বক্তব্য রাখছেন
সাম্প্রতিক সময়ে, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের ১২ দিনের মধ্যে, চীন দ্রুত একটি সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এগিয়ে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে চীনের 'সীমিত ক্ষমতা' প্রকাশ পেয়েছে, চীন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলে মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ইতিহাস সত্ত্বেও, এবার তাদের ভূমিকা ছিল সীমিত।
১৩ জুন ইরানের উপর ইসরায়েলের বিনা উস্কানিতে আক্রমণের পরের দিন, বেইজিং উভয় পক্ষের সাথে মধ্যস্থতামূলক সমাধানের পথে এগোয়, এমনকি দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানান।
চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং শীঘ্রই উত্তেজনা কমার আহ্বান জানান, যে সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীন রাশিয়া ও পাকিস্তানের সাথে "তাৎক্ষণিক এবং নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি" আহ্বান জানায়।
যখন ইরান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালী অবরোধের হুমকি দেয়, যেখান দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল পরিবহন করা হয়, তখন বেইজিংও দ্রুত কথা বলতে শুরু করে।
যার কারণে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় "আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সংঘাত কমাতে এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর বৃহত্তর প্রভাব ফেলতে পারে বলে জানান। তা যেন না হয় সেই প্রচেষ্টা জোরদার করার" আহ্বান জানিয়েছে।
সংঘাত জুড়ে বেইজিংয়ের অবস্থান ছিল বিদেশী শত্রুতার প্রতি তার দীর্ঘস্থায়ী অ-হস্তক্ষেপমূলক পদ্ধতির প্রতি অনড় অবস্থান। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী খেলোয়াড় হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করতে খুব কমই সাহায্য করেছে, বরং এই অঞ্চলে তার প্রভাবের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে।
চীন কেন চিন্তিত ছিল?
সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহযোগী ইভাঞ্জেলিন চেং আল জাজিরাকে বলেন, কিছু কিছু দেশের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের ব্যাপারে চীন ঐতিহ্যগতভাবে "আদর্শিক সংহতির পরিবর্তে কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে" পররাষ্ট্রনীতির দিকে নজর দেয়।
এই পদ্ধতির অর্থ হল চীন সর্বদা তার অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার দিকে মনোনিবেশ করবে, যার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে এর অনেকগুলি দেশ রয়েছে।
ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে এবং এর বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো প্রকল্প ইরান, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, ইরাক, মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত জুড়ে বিস্তৃত্ব।
তিনি বলেন, চীন তার অর্ধেকেরও বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভর করে এবং এটি ইরানি তেলের শীর্ষ ভোক্তা। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফলে তাদের তেল সরবরাহ ব্যাহত হত, যেমন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালীতে ইরানের অবরোধ - যা সংঘাতের সময় তেহরানের সংসদ দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইরানি স্টাডিজের একজন সিনিয়র লেকচারার আলম সালেহ বলেন,
যুদ্ধ এবং নিরাপত্তা অস্থিতিশীলতা কেবল চীনা বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও ব্যবসাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না... বরং সাধারণভাবে তেলের দাম এবং গ্যাস জ্বালানি নিরাপত্তাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
তিনি বলেন, অতএব, চীন স্থিতিশীলতা চায়, এবং যেকোনো ধরণের সংঘাত ও সংঘর্ষের জন্য যেকোনো ধরণের সামরিক সমাধানের সাথে তারা একমত নয় বরং চীন এর বিরোধিতা করে, তা সে কারো সাথেই হোক না কেন,”
বেইজিংয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জন গং আল জাজিরাকে বলেন যে, এই সংঘাতের মাধ্যমে চীনের প্রধান উদ্বেগ হলো তেলের দাম আকাশছোঁয়া হওয়া এড়ানো যা তার জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
কূটনৈতিক শক্তি প্রদর্শন, অর্থনৈতিক শক্তি রক্ষা
ইরানের সাথে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এবং বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক ভয় সম্পর্কে জানেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বেইজিংকে অনুরোধ করেন, তেহরানকে বুঝাতে যেন, ইরান যেন হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ এই সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি আলোচনা এগিয়ে যাচ্ছে।
এটি বেইজিংয়ের প্রভাব স্বীকার করার একটি ভাল মুহূর্ত ছিল, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে চীনের সামগ্রিক কূটনৈতিক প্রভাব এখনও সীমিত।
চেং বলেন, "চীনের মধ্যস্থতার প্রস্তাব একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক খেলোয়াড় হিসেবে দেখা তাদের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে, কিন্তু তাদের প্রকৃত প্রভাব সীমিত রয়ে গেছে," "এই অঞ্চলে সামরিক সক্ষমতা বা গভীর রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া এবং ইরানের সাথে বেইজিংয়ের সম্পর্ক নিয়ে ইসরায়েলের সতর্ক থাকার কারণে, চীনের ভূমিকা অবশ্যই সীমিত।"
নিশ্চিতভাবেই, বেইজিং এই অঞ্চলে বড় বড় কূটনৈতিক চুক্তিতে মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। ২০২৩ সালে, এটি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে মধ্যস্থতা করেছিল। চীনের জন্য এটি একটি বিশাল কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখা হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে বেইজিং তার সাফল্যের জন্য অনেকটাই সহ-মধ্যস্থতাকারী, ওমান এবং ইরাকের কাছে ঋণী। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে হামাস এবং ফাতাহ সহ ফিলিস্তিনি দলগুলির মধ্যে একটি চুক্তিতেও মধ্যস্থতা করেছিল চীন, যার অধীনে তারা ছিটমহলে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের অবসানের পর গাজার শাসনব্যবস্থায় একসাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল।
কিন্তু ব্রাসেলস-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একজন জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক উইলিয়াম ইয়াং বলেছেন, ইরানের সাথে সম্পর্কের প্রতি ইসরায়েলের সতর্কতার কারণে সর্বশেষ সংঘাতের শুরু থেকেই চীনের বিরুদ্ধে প্রতিকূলতা তৈরি হয়েছিল।
২০২১ সালে, চীন এবং ইরান ২৫ বছরের "কৌশলগত অংশীদারিত্ব" স্বাক্ষর করে এবং ইরান বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। ইরান বেইজিং-নেতৃত্বাধীন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায়ও যোগ দিয়েছে এবং এই বছর চীনের "মেরিটাইম সিকিউরিটি বেল্ট" নৌ মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
ইয়াং বলেন, ইরানের "আমেরিকান আধিপত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় বিরোধিতা" চীনের কূটনৈতিক স্বার্থের সাথে আরও বিস্তৃতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ইসরায়েলের আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের তুলনায়।
চীনের দ্বিধা
ইয়াং বলেন, এটি এমন একটি পরিস্থিতি যা ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এই ঘটনাটি চীনের মুখোমুখি দ্বিধাকেও আরও জোরদার করে: যদিও তারা একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে দেখাতে চায় যারা বড় বড় বৈশ্বিক সংঘাতে মধ্যস্থতা করতে সক্ষম, তবুও চলমান কিছু সংঘাতে নির্দিষ্ট পক্ষের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বেইজিংয়ের এই ধরনের ভূমিকা পালনের ক্ষমতাকে হ্রাস করে,”
তিনি আরও বলেন, আপাতত, বেইজিং এই অঞ্চলে নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল থাকবে।
“এটা স্পষ্ট যে চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার দিকে মনোনিবেশ করবে এবং একই সাথে এই অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতির সুযোগ নেবে, যা আঞ্চলিক দেশগুলির জন্য প্রাথমিক নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসেবে রয়ে গেছে,” ইয়াং বলেন।
"অন্যদিকে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে বোমা হামলা চালিয়ে যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন সহ সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার ফলে চীন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নৈতিক উচ্চতা অর্জন করতে এবং নিজেকে আরও সংযত, শান্ত এবং দায়িত্বশীল প্রধান শক্তি হিসাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
অনুবাদ সূত্র: আল জাজিরা
তাসমিম