
বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
মাত্র এক বছর আগে জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়েন দীর্ঘদিনের শাসক শেখ হাসিনা। কয়েক সপ্তাহের এই আন্দোলনে প্রাণ হারায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ, আহত হন বহু। ক্ষমতা গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শুরুর প্রতিশ্রুতি ছিল স্পষ্ট—গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করা।
কিন্তু বছর ঘুরতেই প্রশ্ন উঠছে—এগোচ্ছে কি বাংলাদেশ, নাকি প্রতিশোধ আর বিভাজনের পথে হাঁটছে?
রাজনীতিতে উত্তাপ, দলে বিভাজন
শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে “জাতীয় নিরাপত্তার” উদ্বেগের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আদালতে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দলটি নিষ্ক্রিয় থাকবে।
অপরদিকে, ১৫০টি রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনের জন্য নিবন্ধিত হয়েছে, যার মধ্যে অনেক নবাগত। শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (NCP) নতুন প্রজন্মের আশা জাগালেও জনমত জরিপ বলছে, তাদের সমর্থন মাত্র (৫%)। বরং পুরোনো দুইদল বিএনপি (৪২%) ও জামায়াতে ইসলামি (৩২%) এগিয়ে।
উদার মহল আশঙ্কা করছে, ইসলামপন্থিদের উত্থান রাষ্ট্রকে ধর্মীয় চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আবার বিএনপিকেও অনেকেই দেখছেন আগের সরকারেরই প্রতিচ্ছায়া হিসেবে—দুর্নীতিগ্রস্ত ও আত্মতুষ্ট।
অর্থনীতির মিশ্র বার্তা
অর্থনৈতিক দিক থেকে সরকার কিছুটা স্বস্তি এনে দিতে পেরেছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসেবে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৯%—যদিও আগের বছরের ৪.২%-এর চেয়ে কম, তবুও প্রত্যাশার চেয়ে ভালো। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, প্রবাসী আয় বাড়ছে, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে।
এছাড়া ব্যাংকিং খাত থেকে অনিয়ম দূর করতে সরকার সক্রিয়, এবং বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। এর স্বীকৃতি হিসেবে আইএমএফ ও ADB বহু বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে।
তবে সমস্যার মূল জায়গাগুলো এখনো ঠিকঠাক স্পর্শ করা হয়নি। শিল্প বহুমুখীকরণ হয়নি, অবকাঠামো নাজুক, এবং তরুণদের জন্য চাকরির সংকট দিন দিন বাড়ছে।
পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব
পররাষ্ট্রনীতিতে সরকারের পদক্ষেপ অনেককে বিস্মিত করেছে।
চীনের সঙ্গে গভীরতা বাড়াতে গিয়ে বাংলাদেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। মার্চে ইউনুসের প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল চীনে। সেখানে J10C ও JF17 যুদ্ধবিমান কেনার আলোচনা হয়—যা পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে ব্যবহার করেছিল।
এরপর জুনে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান ত্রিপাক্ষিক সম্মেলন করে। এই ঘটনাগুলো ভারতকে ক্ষুব্ধ করেছে। এপ্রিলেই ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্স-শিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন ৩৭% প্রতিশোধমূলক শুল্কের মুখে, যা জুলাইয়ে কার্যকর হওয়ার কথা।
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
ইউনুস সরকার বলছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে “জুলাই সনদ” নামে একটি রাজনৈতিক চুক্তি হবে, যেখানে নির্বাচন ও সংস্কারের রূপরেখা থাকবে। কিন্তু এই দলিল কেমন হবে, কে কে স্বাক্ষর করবে—তা এখনো অস্পষ্ট।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের শাস্তি দেওয়ার মনোভাব কতটা গণতন্ত্রের পথচলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করেছে, নতুন সরকার “ইচ্ছামতো” আওয়ামী সমর্থকদের টার্গেট করছে, ঠিক যেমন আগের সরকার বিরোধীদের করত।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আইন বিশেষজ্ঞ আরাফাত খান বলেছেন, “বাংলাদেশের দরকার একটি নেলসন ম্যান্ডেলা মুহূর্ত”—অর্থাৎ শুদ্ধি নয়, প্রয়োজন ঐক্য।
বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি পথ—সংস্কার ও সমবায়, অথবা প্রতিশোধ ও বিভাজন।
শুধু একটি নতুন সরকার নয়, প্রয়োজন একটি নতুন মানসিকতা। যেখানে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোনো যাবে—সবার অংশগ্রহণে, সমান সুযোগে, স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে।
তথ্যসূত্র: The Economist, জুন ২০২৫ সংস্করণ
Mily