
ছবি: সংগৃহীত
আপনার পুরনো আইফোন বা ল্যাপটপে হয়তো লুকিয়ে আছে কয়েক মিলিগ্রাম সোনা—যা এতদিন আপনার অজানাই ছিল। এই সোনা নিঃসন্দেহে মূল্যবান, কিন্তু এটি নিরাপদভাবে উত্তোলন করা ছিল বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এবার সেই সমস্যারই সম্ভাব্য সমাধান দিলেন একদল সুইস গবেষক। তারা বলছেন, একটি নতুন কৌশলের মাধ্যমে এখন ইলেকট্রনিক বর্জ্য (ই-ওয়েস্ট) থেকে সোনা উত্তোলন করা সম্ভব হবে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ উপায়ে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা নিবন্ধে (Nature Sustainability জার্নালে প্রকাশিত) বিজ্ঞানীরা জানান, তাদের উদ্ভাবিত নতুন এই প্রযুক্তি শুধু ই-ওয়েস্ট থেকেই নয়, ছোট আকারের খনিতেও পারদ ও সায়ানাইডের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হবে। এভাবে সোনা উত্তোলনের প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে আরও টেকসই ও মানবদেহ ও প্রকৃতির জন্য নিরাপদ।
বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ই-ওয়েস্ট
২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী উৎপন্ন ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৬২ মিলিয়ন টন, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৮২ মিলিয়ন টনে। এই বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে পুরনো মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, সার্কিট বোর্ডসহ বহু ডিভাইস, যেগুলোর ভেতরে সোনা, রূপা, কপার ইত্যাদি মূল্যবান ধাতু থাকে। কিন্তু এসবের খুব সামান্য অংশই যথাযথভাবে রিসাইকেল করা হয়।
গবেষকদের মতে, এই অপচয় কমিয়ে এনে যদি নিরাপদ ও কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু পুনরুদ্ধার করা যায়, তাহলে তা পরিবেশ, অর্থনীতি এবং খনিজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা—তিনটি ক্ষেত্রেই দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পারদ ও সায়ানাইড নয়, এবার ক্লোরিনজাত পদার্থ
সাধারণত সোনা উত্তোলনে বড় আকারের খনিতে সায়ানাইড এবং ছোট খনিতে পারদের ব্যবহার হয়ে থাকে। দুটি উপাদানই মারাত্মক বিষাক্ত এবং পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। পারদ ব্যবহার করে সোনা উত্তোলনের সময় তা বাষ্প হয়ে যায় এবং বাতাস ও পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী পারদ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে ধরা হয় এই ছোট খনি কার্যক্রমকেই।
নতুন পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন ট্রাইক্লোরোআইসোসায়ানিউরিক অ্যাসিড নামের এক যৌগ, যা সাধারণত পানি বিশুদ্ধকরণ ও সুইমিং পুল পরিষ্কারে ব্যবহৃত হয়। এই রাসায়নিকটি লবণজলে সক্রিয় হয়ে সোনাকে পানিতে দ্রবণীয় অবস্থায় পরিণত করে। এরপর সেখান থেকে সোনা আলাদা করতে ব্যবহৃত হয় এক বিশেষ ধরণের সালফার-সমৃদ্ধ পলিমার।
এই পলিমারটি তৈরি হয়েছে মৌলিক সালফার দিয়ে, যা মূলত পেট্রোলিয়াম শিল্পে ব্যবহারের পর অতিরিক্ত হিসেবে রয়ে যায়। অর্থাৎ, পলিমারটিও পরিবেশবান্ধব এবং স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি ও ‘সার্কুলার ইকোনমি’
এই সোনা উত্তোলন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় দিক হলো, এটি পুরোপুরি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। গবেষকরা এমন প্রযুক্তি তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে ব্যবহৃত রাসায়নিক ও পলিমার বারবার পুনঃপ্রস্তুত করা যায়। এমনকি পলিমার যখন সোনা সংগ্রহ করে নেয়, তখন আলো ব্যবহার করে তাকে আবার তার মূল উপাদানে ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়। এতে করে একই উপাদান দিয়ে বহুবার সোনা উত্তোলন করা যাবে।
এই প্রযুক্তি সফল হলে শুধু খনিচালিত অঞ্চল নয়, ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিং বা তথাকথিত ‘আর্বান মাইনিং’-এর ক্ষেত্রেও সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু সংগ্রহের একটি নিরাপদ উপায় হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: ছোট খনি ও রিমোট অঞ্চলে বাস্তবায়নের লক্ষ্য
গবেষকরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চান, যাতে এই প্রযুক্তি ছোট ও প্রান্তিক খনিতে প্রয়োগ করা যায়। কারণ এসব খনিতে সাধারণত স্থানীয় বাসিন্দারা কাজ করেন, যাদের জন্য এটাই প্রধান জীবিকা। তাদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা অক্ষুণ্ন রেখে পারদের বিপজ্জনক ব্যবহার বন্ধ করাই গবেষকদের প্রধান লক্ষ্য।
তবে এখনও এই প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। উৎপাদন বাড়ানো, খরচ কমানো ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা অর্জন—এই তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ এখন সামনে।
গবেষক দল আশা করছেন, এই পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন শুধু সোনা উত্তোলনকেই নিরাপদ করবে না, বরং পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি বৈশ্বিক ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকেও আরও কার্যকর করে তুলবে।
বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে চাইলে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ বাংলাদেশেও হতে পারে, যেখানে ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিং বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খনি কার্যক্রমের সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন।
রাকিব