
ছবি: সংগৃহীত।
শিশুদের কথা না শোনা—এ যেন প্রতিটি অভিভাবকের পরিচিত সমস্যা। কিন্তু অনেক বাবা-মা রয়েছেন, যাদের শিশুদের সহযোগিতা পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এমন বাবা-মায়ের ভাষা ব্যবহারে রয়েছে এক বিশেষ ধরনের কৌশল, যা শিশুদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করতে শেখায়।
একজন শিশুমন বিশেষজ্ঞ ২০০-র বেশি অভিভাবক-শিশু সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, সফল অভিভাবকরা সাধারণত হুমকি, ঘুষ বা কঠোর শাস্তির ভাষা ব্যবহার করেন না। বরং তারা এমনভাবে কথা বলেন, যা শিশুর স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা রক্ষা করে এবং একইসাথে নিয়মও বজায় রাখে।
তার গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এমন ৫টি প্রচলিত কিন্তু ক্ষতিকর বাক্য তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো শিশুরা শুনতে চায় না— এবং তার পরিবর্তে কী বলা উচিত, তাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
১. কখনই বলবেন না: “কারণ আমি বলেছি, তাই।”
পরিবর্তে বলুন: “তুমি হয়তো এই সিদ্ধান্তটা পছন্দ করোনি। আমি ব্যাখ্যা করছি, তারপর আমরা এগোবো।”
“আমি বলেছি”—এই ধরনের বাক্য শিশুর চিন্তা বন্ধ করে দেয়, তাদের বোঝার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু যদি আপনি ছোট করে ব্যাখ্যা করেন, তবে শিশু অনুভব করে যে তাকে সম্মান করা হচ্ছে। এতে আপনার নেতৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু সম্মানের মাধ্যমে।
২. বলবেন না: “যদি না শুনো, তবে তোমার খেলাধুলা বন্ধ।”
পরিবর্তে বলুন: “তুমি যখন প্রস্তুত হবে নির্দিষ্ট কাজটি করতে, তখন আমরা তোমার পছন্দের কাজটি করব।”
হুমকি শিশুকে রক্ষণাত্মক করে তোলে। পরিবর্তিত বাক্যটিতে সীমারেখা বজায় থাকে, তবে শিশুকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়। এতে জেদ নয়, বরং সহনশীল আচরণ তৈরি হয়।
৩. বলবেন না: “কেঁদো না, তুমি ঠিক আছো।”
পরিবর্তে বলুন: “তুমি খুব কষ্টে আছো মনে হচ্ছে। কী হয়েছে বলো তো?”
শিশুর আবেগ উপেক্ষা করলে তারা ভাবতে শেখে, তাদের অনুভব মূল্যহীন। কিন্তু তাদের কষ্ট স্বীকার করে কথা বললে তারা দ্রুত শান্ত হয় এবং আপনার ওপর আস্থা রাখে।
৪. বলবেন না: “আর কতবার বলতে হবে?”
পরিবর্তে বলুন: “আমি কয়েকবার বলেছি। বলো তো, এটা তোমার জন্য কঠিন কেন?”
এই প্রশ্নে ধরে নেওয়া হয় যে শিশু ইচ্ছে করে না শুনছে। কিন্তু অনেক সময় শিশুর দেরির পেছনে থাকে বিভ্রান্তি, মানসিক দূরত্ব বা কোনো অক্ষমতা। এভাবে বললে আপনি সমস্যার গভীরে পৌঁছাতে পারবেন।
৫. বলবেন না: “তুমি তো জানো, এটা ঠিক না।”
পরিবর্তে বলুন: “তোমার সেরা রূপটা কিছু একটা থামিয়ে দিচ্ছে মনে হচ্ছে। চল, এটা নিয়ে কথা বলি।”
“তুমি তো জানো” বললে শিশু লজ্জিত হয়, আত্মবিশ্বাস হারায়। তবে বিকল্প বাক্যে আপনি তার ভেতরের সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেন, এবং সাহচর্যের মাধ্যমে ভুল শুধরানোর সুযোগ দেন।
বিশেষজ্ঞের মতে, শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে সহযোগিতা সহজভাবে জন্ম নেয়।
শিশুরা তখনই উন্নতি করে, যখন তারা সম্মানিত বোধ করে, আবেগগতভাবে নিরাপদ থাকে এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে।
এই ভাষাগত পরিবর্তন শুধু শব্দ নয়—এটি পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গির এক গভীর রূপান্তর।
যেখানে অবাধ্যতাকে দমনযোগ্য সমস্যা না ভেবে দেখা হয় সংযোগ, সহানুভূতি ও দিকনির্দেশনার সুযোগ হিসেবে।
যখন অভিভাবকরা কঠোরতার পরিবর্তে সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব দেন, তখন শিশুরাও হয়ে ওঠে আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম, আস্থা ও সহানুভূতিতে সমৃদ্ধ একজন ভবিষ্যৎ নাগরিক।
সায়মা ইসলাম