ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিক্রমপুর: ৫৪০ বছরের বাবা আদম মসজিদ

সালাহউদ্দিন সালমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ।

প্রকাশিত: ২১:৩১, ২৪ জুন ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিক্রমপুর: ৫৪০ বছরের বাবা আদম মসজিদ

বিক্রমপুরের পবিত্র মাটি—যেখানে পদ্মা ও ধলেশ্বরীর ঢেউয়ে ভেসে আসে ইতিহাস, ধূপ-ধুনায় মিশে থাকে দরবেশি ঘ্রাণ। সেই মাটিতে আজও স্থির দাঁড়িয়ে আছে এক ৫৪০ বছরের সাক্ষী—বাবা আদম মসজিদ, যা কেবল ইট-পাথরের গাঁথুনি নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত এক অলোকসন্ধানী দরবেশের আত্মত্যাগ, সাধনা ও স্মৃতির অনন্ত প্রতিচ্ছবি।

মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার দরগাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত এই ৬ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি যেন দাঁড়িয়ে আছে সাধকদের এক নীরব শোভাযাত্রায়। পবিত্র ফারসি শিলালিপি আর প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর নিখুঁত ছোঁয়ায় গড়া এই পবিত্র মসজিদ যেন আধ্যাত্মিক নকশায় রচিত এক সুরেলা ধ্যানমন্দির।

বাবা আদম রহ. ছিলেন এক সুফি সাধক—যিনি ১১৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিক্রমপুরে আসেন, হৃদয়ে ইসলামের জ্যোতি নিয়ে। তখন রাজত্ব করছিলেন বল্লাল সেন। ইতিহাস বলে, ধর্ম ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে মুখোমুখি হয়েছিলেন এই পীর ও রাজা। সাহসিকতার সেই যুদ্ধ শেষে শহিদ হন বাবা আদম, এবং বহু বছর পর, ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের শাসনামলে মালিক কাফুর তাঁর স্মরণে নির্মাণ করেন এই পবিত্র মসজিদ।

মসজিদটির নির্মাণ কৌশল যেন সুফি আধ্যাত্মিকতায় মিশে থাকা এক অলৌকিক সৌন্দর্য। ৪৩ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩৬ ফুট প্রস্থের এই মসজিদে রয়েছে ছয়টি মোহনীয় গম্বুজ। চওড়া দেওয়াল যেন এক দুর্গের শক্ত দেয়াল, তার উপর ইটের কারুকাজ, পাতলা ইট কেটে কোরআনিক শিল্পের ছাপ—সবই জানান দেয় এটি কেবল নামাজের স্থান নয়, বরং এটি এক আত্মিক কেন্দ্র, এক ইলহামঘেরা প্রার্থনাস্থল।

সামনের প্রবেশপথের ফারসি শিলালিপি, দুই পাশে খিলান জানালা, আর দেয়ালের গায়ে অলঙ্কারময় কারুকাজ যেন বলছে—“এ মসজিদে এলে শুধু ইট দেখো না, দেখো আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের ছাপ।” দিনের বেলায় জানালার সীমিত আলোতে মসজিদের ভেতরটা আবছা থাকে, যেন ভেতরের পরিবেশ আপনাআপনি ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ে।

মসজিদের চার কোণায় ষড়ভুজ স্তম্ভ আর সুচারু ইমারত নির্মাণের দৃষ্টান্ত নিঃসন্দেহে মুসলিম স্থাপত্যের এক স্বর্ণযুগের স্মারক। আজও এই মসজিদে নিয়মিত জামাত হয়। সামনের প্রাঙ্গণে কংক্রিট ঢালাই করে সম্প্রসারিত স্থান প্রস্তুত করা হয়েছে মুসল্লিদের জন্য।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এই মসজিদের সম্মানে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটিকে সংরক্ষিত পুরাকৃতি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, স্বাধীনতার পরে মসজিদটির কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়নি। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক ও ধর্মপ্রাণদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এর সুরক্ষায় আরও যত্নবান হওয়া জরুরি।

বাবা আদম দরবেশের শহিদি আত্মা আজও যেন বিক্রমপুরের বাতাসে ভেসে বেড়ায়—তার স্মৃতির ছায়া পড়ে এই মসজিদের প্রতিটি ইটে, প্রতিটি গম্বুজে। মসজিদ নয়—এটি একটি সময়, একটি সাধনা, একটি ত্যাগের নিদর্শন।

মসজিদের ফারসি শিলালিপি, ইটের কারুকাজ, গম্বুজের নকশা এবং নামাজরত মুহূর্তগুলো নিয়ে একটি আলোকচিত্র সংরক্ষণ প্রকল্প চালু হলে, দেশের ইসলামিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক মহান অধ্যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উন্মোচিত হতে পারে বলে জানান স্থানীয়রা।

আফরোজা

×