
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদ-নদী। কবি-সাহিত্যিকের ভাষায় বাংলাদেশ ১৩শ নদীর দেশ। বইপুস্তকে ৭০০ নদ-নদীর কথা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবহমান নদ-নদীর সংখ্যা ২৩০। বাংলাদেশের অবস্থান হিমালয় পর্বতের পাদদেশে হওয়ায় এবং ব্রহ্মপুত্র, পদ্মাসহ অনেক নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বতে হওয়ায় বাংলাদেশকে ভৌগোলিকভাবে ভাটির দেশ বলা হয়। নদীবাহিত পলি-বালি দ্বারা গঠিত বাংলাদেশ মূলত প্লাবনভূমির দেশ।
বাংলাদেশের নদীসমূহ শুধু প্রকৃতিতেই নয়, নামের বৈচিত্র্যেও বিস্ময় জাগায়। দেশের বিভিন্ন জেলার নদীর নামে মেলে লোকজ ধারা, হাস্যরস, পাখি, প্রাণী, আচরণ এমনকি শারীরিক বৈশিষ্ট্যও।
পঞ্চগড়ে আছে ‘ঘাগড়া’ নামে একটি নদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘ঘুঙ্গুর’, আর নরসিংদীতে ‘কাঁকন’। যশোরে ‘টেকা’, বরিশালে ‘পয়সা’, সিরাজগঞ্জে ‘দশসিকা’, জামালগঞ্জে ‘দশানী’ নামের নদী পাওয়া যায়।
ফরিদপুরে রয়েছে ‘কুমার’, চট্টগ্রামে ‘ধোপা’, নওগাঁয় ‘গোয়ালা’, সিরাজগঞ্জে ‘গোহালা’। খুলনায় ‘ছেঁড়া’ ও টাঙ্গাইলে ‘ফুটা’ নদীর অস্তিত্ব মেলে।
পটুয়াখালীতে ‘পায়রা’, খুলনায় ‘ময়ূর’, দিনাজপুরে ‘শুক’ (টিয়া), সিলেটে ‘সারি’ (শালিক), বাগেরহাটে ‘বগী’, সিলেটে ‘কুড়া’, রাজশাহীতে ‘কোয়েল’, রাজবাড়ীতে ‘চন্দনা’, পঞ্চগড়ে ‘ডাহুক’, সুনামগঞ্জে ‘ডাহুকা’ ও মৌলভীবাজারে ‘মুনিয়া’ নামের নদী রয়েছে—সবই পাখির নামে।
সিলেটে ‘ধলা’ নদী, দিনাজপুরে ‘কালা’, হবিগঞ্জে ‘শুঁটকি’, পঞ্চগড়ে ‘পেটকি’ এবং পাবনায় ‘চিকনাই’ নদী রয়েছে।
নোয়াখালীতে আছে ‘বামনী’, নওগাঁয় ‘ফকিরনি’।
চুয়াডাঙ্গায় ‘মাথাভাঙ্গা’, নীলফামারীতে ‘চুঙ্গাভাঙ্গা’, হবিগঞ্জে ‘হাওরভাঙ্গা’, সাতক্ষীরায় ‘হাঁড়িয়াভাঙ্গা’, পটুয়াখালীতে ‘খাপড়াভাঙ্গা’, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘নাওভাঙ্গা’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘ছিটিভাঙ্গা’ নদী—সবগুলোতেই রয়েছে ভাঙনের ছাপ।
বাগেরহাটে ‘পুঁটিমারা’, লালমনিরহাটে ‘সিঙ্গীমারা’, খুলনায় ‘শোলমারা’, খাগড়াছড়িতে ‘গুইমারা’, সাতক্ষীরায় ‘সাপমারা’, পঞ্চগড়ে ‘ঘোড়ামারা’, হবিগঞ্জে ‘হাতিমারা’, চুয়াডাঙ্গায় ‘ভাইমারা’, সুনামগঞ্জে ‘খাসিয়ামারা’ নদী পাওয়া যায়।
খুলনায় ‘ঢাকী’ আর সাভারে ‘বংশী’ নদী আছে।
সিলেটে আছে ‘লুলা’, নীলফামারীতে ‘খোড়া’, ছাতকে ‘বোকা’, সিলেটেই আবার ‘খ্যাপা’ নদী।
নেত্রকোনায় ‘মগরা’, মাগুরায় ‘ফটকি’, ময়মনসিংহে ‘মঘা’, গাইবান্ধায় ‘ল্যাঙ্গা’, সাতক্ষীরায় ‘হাবড়া’, রাজশাহীতে ‘হোজা’ নদীর নাম পাওয়া যায়।
বরিশালে আছে ‘লঙ্কা’, নাটোরে ‘গুড়’, ময়মনসিংহে ‘ক্ষীর’, ঠাকুরগাঁওয়ে ‘লোনা’। সিলেটে ‘নুনছড়া’, বরিশালে ‘কালিজিরা’, সুনামগঞ্জে ‘লাউগাং’, ঠাকুরগাঁওয়ে ‘লাচ্ছি’ নদী রয়েছে।
পাবনায় ‘কমলা’, সুনামগঞ্জে ‘খুরমা’, কুমিল্লায় ‘কালাডুমুর’।
সিলেটের জকিগঞ্জে আছে ‘তাল’ ও ‘কুল’ নামে দুটি গাং। ফেনীতে ‘মুহুরী’, মৌলভীবাজারে ‘জুড়ী’, রংপুরে ‘কাঠগড়া’ নদী রয়েছে।
ভোলায় ‘কলমি’, শরীয়তপুরে ‘পালং’, মাদারীপুরে ‘ময়নাকাঁটা’, বরিশালে ‘লতা’, আর সিলেটে আছে ‘শ্যাওলা’ নদী।
হবিগঞ্জে ‘কলকলিয়া’, কুড়িগ্রামে ‘হলহলিয়া’, গোপালগঞ্জে ‘ঝনঝনিয়া’, খুলনায় ‘ঝপঝপিয়া’, জামালপুরে ‘জিরজিরা’, গাজীপুরে ‘গড়গড়া’ নদী পাওয়া যায়।
ঝালকাঠি ও বরগুনায় আছে ‘বিষখালী’, বিপরীতে মাগুরায় আছে ‘নির্বিষখালী’। গাজীপুরে ‘বালু’, হবিগঞ্জে ‘বালিখাল’, চট্টগ্রামে ‘বালুখালী’ এবং নওগাঁয় ‘বালুভরা’ নদীর দেখা মেলে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘পাগলা’ ও কুমিল্লায় ‘পাগলি’ নদী, নেত্রকোনায় ‘সতা’, লালমনিরহাটে ‘সতি’, দিনাজপুরে ‘মহিলা’, ফরিদপুরে ‘পুরুষালি’ এবং সিলেটে ‘মাকুন্দা’ নামে নদী রয়েছে।
প্রসঙ্গত, এই নদীগুলোর নাম ও অবস্থান মূলত স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত এবং বহু ক্ষেত্রে মানচিত্র বা সরকারি নথিতে এসব নদীর নাম ভিন্ন হতে পারে বা এই নামে না-ও পাওয়া যেতে পারে। অনেক নাম লোকজ বা উপনামের মতো ব্যবহৃত হয়—যা স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ। এগুলোর নাম তথ্যবহুল ও সাংস্কৃতিক মূল্যবান হলেও, একে সরকারিভাবে স্বীকৃত নদীর তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবুও এই তালিকা নদী নামের বৈচিত্র্য ও ভাষাভিত্তিক রসধারার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
Jahan