ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

মুকসুদপুরের চান্দা বিল

নৈসর্গিক রূপের খনি জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি

শরিফুল রোমান

প্রকাশিত: ০০:১৪, ২৫ জুন ২০২৫

নৈসর্গিক রূপের খনি জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি

মুকসুদপুরের চান্দা বিলের অপরূপ দৃশ্য

জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি এ বিলে মানুষের জীবনধারা  বর্ণনাতীত সংগ্রামমুখর। পথ হয়তো বদলায়, জীবন বদলায় না। জীববৈচিত্র্যের আধার ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চান্দা বিল। ২৭টি গ্রাম ও ৬টি মৌজা নিয়ে বিল চান্দার অবস্থান। চান্দা বিলের জন্ম হয়েছে কতদিন আগে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও সুন্দরবনাঞ্চল অধ্যুষিত এ এলাকায় ধারণা করা হয় এক সময় সুন্দরবন ছিল।
কালেরগর্ভে প্রাকৃতিক  দুর্যোগে বা ভূমিকম্পে বনাঞ্চল ধসে বিলের সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কারণ চান্দার মাটিতে প্রচুর পিট কয়লা সে ইঙ্গিত বহন করে। চান্দা বিলের নামকরণেও রয়েছে নানান কল্প কাহিনী। নামকরণের যত কল্পকাহিনী রয়েছে তার মধ্যে গ্রহণযোগ্য হলো যে, মোগল আমলে দক্ষিণ বাংলার বিখ্যাত ব্যবসায়ী চাঁদ সওদাগর বাণিজ্য শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় দৈবাত মালামাল বোঝাই ৭টি নৌকা নিমজ্জিত হওয়ার পরে এই বিলের নাম বিল চান্দা নামকরণ হয়েছে।
চান্দা বিল এলাকায় কয়েক বছর আগেও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা।  এই বিলে রয়েছে প্রচুর  প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ বিলে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ, পাখি-অতিথি পাখি, শাপলা ফুল, পিট কয়লা, কচুরিপানা, শ্যাওলা, কেঁচো, পদ্মফুল, কলমিশাক, হিনচা শাক, পানি লজ্জাবতী গাছ, নল খাগড়া ইত্যাদি নাম না জানা প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণী। 
 এ বিল জীববৈচিত্র্যের আধার ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। চান্দা বিলের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাছ অন্যতম। এখানে প্রায় দেড়শ’ প্রজাতির মাছ এখনো বিদ্যমান। বিল চান্দা থেকে প্রতিদিন ঢাকায় মাছ সরবরাহ করা হয়। এই মাছ ধরা, বিক্রি করা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করে কয়েক হাজার পরিবার। প্রতিদিনই ধরা পড়ে কৈ, শিং, শোল, গজার, দেশি সরপুঁটি, রুই কাতলা, মাগুর, টাকি, পুঁটি, বাইন, টেংরা ও মলা-ঢেলাসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক মাছ ছাড়াও সরকারি অনুদানে উন্মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা হাইব্রিড জাতের মাছ।
চান্দা বিলে স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক সম্পদ হলো পিট কয়লা। নি¤œাঞ্চলের এখনো প্রায় ১ হাজার পরিবারের জীবিকা চলে পিট কয়লা আহরণ ও বিক্রি করে। ক্রেতারা ওই শুকনো কয়লা দিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুত চুলায় রান্না করে। এই চুলায় পরিবেশ দূষণ অর্থাৎ ধোঁয়া হয় না বলে অনেক রাঁধুনি পিট কয়লা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
এলাকার লোকেদের কাছে বর্ষাকালীন সবজি হিসেবে শাপলা বহুল ব্যবহৃত। বিল চান্দার আশপাশের গ্রামবাসীরা বর্ষা মৌসুমে শাপলা সবজি হিসেবে খায়। গোপালগঞ্জ, খুলনা, ঢাকা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের  হাট বাজারে শাপলা সবজি হিসেবে বিক্রি হয়।
আশ্বিন-কার্তিক বা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে শাপলায় গোড়ার পানি কমে যায়। অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী শাপলা গাছের গোড়ায় যে গোটা অংশ থাকে তাকে শালুক বলে। শালুক একটি সুস্বাদু খাবার। বর্ষা মৌসুমে চান্দার বিলের শামুক এখন অর্থকরী পণ্য, চান্দার বিল এলাকার বড়-বড় সাইজের শামুক খুলনা এলাকায় চিংড়ি ঘেরে বিক্রি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে চান্দার বিলের পার্শ্ববর্তী সড়কের পাশে প্রতিদিন বসে শামুক বিক্রির হাট।

জলিরপাড়, কলিগ্রাম, রাঘদী, উজানী, রাহুথড়, বেদগ্রাম, মোচনা এলাকা থেকে প্রতিদিন ৮/১০ ট্রাক ছাড়াও বিল রুট ক্যানেলে নৌকা ভিড়িয়ে কয়েকটি ট্রলারযোগে খুলনা বাগেরহাটসহ বিভিন্ন চিংড়ি চাষ এলাকায় শামুক চলে যায়। এই শামুক খাওয়ার জন্য প্রচুর অতিথি পাখিও আসে। চান্দা বিলের উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুরসহ নি¤œাঞ্চলের অপার প্রাকৃতিক সম্পদ শ্যাওলা। শ্যাওলা আগে কোনো কাজে না লাগলেও বর্তমানে শ্যাওলা মূল্যবান পণ্যে পরিণত হয়েছে। মাছের উৎকৃষ্ট খাদ্য এই শ্যাওলা। পানিফল ও পদ্মফুল জলজ উদ্ভিদ থেকে উৎপাদিত ফসল। পদ্মফুল থেকে মৌমাছি আহরিত মধু ‘পদ্মমধু’ নামে পরিচিত। এর অনেক উপকারিতা। ওই পদ্মফুল বিভিন্ন পূজা অর্চনাতেও ব্যবহৃত হয়। এটারও অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে। 
বিলের পানিতে হিচনা শাক ও কলমি শাক খুবই জনপ্রিয়। পুষ্টিকর ও ঔষধি গুণসম্পন্ন্ এই শাক। বিলে প্রচুর পরিমাণ শাক উৎপন্ন হয়। চান্দা বিল এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে বোনা হয় বিভিন্ন প্রজাতির ধান। এরমধ্যে দিঘা ও শাইল জাতের ধানই বেশি। দিঘার আরও কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। দিঘার ধানের ঢেঁকিছাঁটা চাল এখন অমূল্য সম্পদ। এটা গ্রামেও অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বেশি পানিতে জন্মানো শালিধানের বিভিন্ন প্রজাতির ধানে ভাত ছাড়াও সুস্বাদু মুড়ির ধান হয় এই বিলে।

প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে পাল্টে যেতে পারে ওই এলাকাসহ সারাদেশের জীবনযাত্রা। মুকসুদপুর তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সৌন্দর্যের লীলাভূমি চান্দার বিলকে বাঁচাতে হবে। আর এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের জীবন-জীবিকার আঁধার এ বিল হোক জীব-বৈচিত্র্যের অভায়ারণ্য। টিকে থাকুক যুগের পর যুগ।

×