
ঈদুল আজহার ছুটিতে রাজধানীর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র চিড়িয়াখানায় ছিল দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়
ঈদ এলেই বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় বাড়ে দর্শনার্থীদের ভিড়। চার দেওয়ালে বন্দি শিশুরা পায় প্রকৃতি ও পরিবারের সান্নিধ্য। এর ব্যতিক্রম হয়নি এবারের ঈদেও। পবিত্র ঈদুল আজহার পরের দিন থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা গেছে বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে। বিশেষ করে ঈদের দীর্ঘ ছুটির কারণে প্রতিদিনই উপচেপড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে। রাজধানীর জিয়া উদ্যান, সামরিক জাদুঘর, নভোথিয়েটার, বিমান বাহিনী জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, হাতিরঝিল, শিশুমেলা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
নানারকম ব্যস্ততায় ভরা যান্ত্রিক শহরে পরিবারের জন্য দু’দ- সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে রাজধানীবাসীর। তাই ঈদের ছুটিতে পরিবারকেই সময় দেন চাকরিজীবীরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মুক্ত হাওয়ায় কিছুটা সময় কাটাতে। বিশেষ করে ঈদের সময় ঘোরাঘুরির এই সময়টা পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দে কাটে শিশুদের। বড়রাও প্রকৃতির সানিধ্যে এসে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি পান যান্ত্রিক জীবন থেকে। বিভিন্ন ধরনের গাছপালায় ঘেরা জিয়া উদ্যানে ঈদের দিন বিকেল থেকেই ছিল দর্শনার্থীদের ভিড়। ঈদের চতুর্থ দিনেও অব্যাহত ছিল সেই চাপ। সকাল থেকে তেমন দর্শনার্থীদের ভিড় না থাকলেও দুপুরের পর থেকে তা বাড়তে শুরু করে। কয়েক হাজার মানুষ ভিড় জমান লেকের পাশের এই ছায়া শীতল উদ্যানে।
আগতদের কেউ ঘুরে দেখছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর, কেউবা পাখির কলতানে মুখর হয়ে ঘুরে দেখছেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। কেউবা ছোট শিশুদের নিয়ে লেকের পাশে বসে নিচ্ছেন খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস। কেউবা আবার ব্যস্ত ছবি তোলায় বা বিভিন্ন ধরনের খেলায় অংশ নেওয়ায়। স্বামী, সন্তান, শাশুড়ি ও ননদকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে জিয়া উদ্যানে ঘুরতে এসেছেন সামিয়া রহমান নামে এক গৃহিণী।
তিনি বলেন, ঈদের দিন কোরবানির পশু কাটাকাটির জন্য বের হওয়া হয়নি। আজ শিশুদের নিয়ে এসেছি। তিনি আরও বলেন, শিশুরা তো সব সময় ঘরেই থাকে। দূষণ ও যানজটের কারণে তাদের নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া হয় না। তাই প্রতি ঈদেই তাদের নিয়ে ঘুরতে বের হই। তারা এতে খুব খুশি হয়। ঈদের দিন থেকেই জিজ্ঞেস করতে থাকে কখন ঘুরতে বের হবো। জিয়া উদ্যানে বাদাম বিক্রি করেন বেলাল। তিনি বলেন, ঈদের দিন দর্শনার্থী কিছুটা কম ছিল। কিন্তু পর থেকে দর্শনার্থী বাড়ছে।
কিন্তু গরমের কারণে বাদাম বিক্রি ভালো হচ্ছে না। রাজধানীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র বিজয় সরণি মোড়ে অবস্থিত নভোথিয়েটার। প্রতি ঈদেই অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে ঘুরতে আসেন। মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্র অবাক বনে যায় শিশুরা। তবে এবার অব্যবস্থাপনার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে আগতদের। নভোথিয়েটারে ঢুকতে টিকিট কাটার লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তাদের। দর্শনার্থীদের অভিযোগ, নভোথিয়েটারে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা নেই। আবার কাউন্টারে মাত্র একজন টিকিট দিচ্ছে। অথচ লাইনে দাঁড়ানো কয়েকশ’ মানুষ। ফলে প্রত্যেককেই ঘণ্টাখানেকের বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে টিকিট কাটতে।
ঈদে ঘুরতে বের হয়ে এই ধরনের ভোগান্তি মেনে নেওয়া যায় না। দীর্ঘ লাইনের কারণে টিকিট না কেটেই ফিরে যাচ্ছিলেন নাখালপাড়ার বাসিন্দা মো. আতাউল্লাহ। তিনি বলেন, বাসার পাশেই হওয়ায় ভেবেছিলাম পরিবার নিয়ে নভোথিয়েটার ঘুরবো। সন্তানদের একটু ভালো সময় কাটবে। কিন্তু এখানে যে লাইন, তাতে সন্তানরা বরং বিরক্ত হবে।
তার থেকে ভালো সামরিক জাদুঘর ঘুরে আসি। নভোথিয়েটারের পাশেই অবস্থিত সামরিক জাদুঘর। নভোথিয়েটারে টিকিটের দীর্ঘ সারি দেখা গেলেও সামরিক জাদুঘরে ঢুকতে তেমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না আগতদের। বরং লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াই টিকিট কেটে সামরিক জাদুঘরের বিভিন্ন সামরিক যান উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা। রাজধানীর শাহজাহানপুর থেকে পরিবার নিয়ে সামরিক জাদুঘরে আসা গৃহিণী মৌসুমী ইসলাম বলেন, টিকেট কাটতে কোনো কষ্টই হয়নি। গতকাল বেইলি রোডে ঘুরেছি। আজ এখানে ঘোরার পর যদি সময় পাই তাহলে অন্য জায়গায়ও যাব।
প্রতিটি বিনোদন কেন্দ্রেই গুটি কয়েক ভ্রাম্যমাণ দোকান দেখা গেছে। তবে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এসব দোকানের আধিক্য ছিল অনেক বেশি। যেন রীতিমতো দোকানের মেলা বসেছে। খাবার দোকান থেকে শুরু করে নারীদের বিভিন্ন সাজগোজের দোকান দেখা গেছে সংসদ ভবনের সামনে। আগতরা সেসব দোকান থেকে কেনাকাটা ও খাওয়া-দাওয়া করছেন। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে শিশুদের বিভিন্ন খেলানার দোকান। সেসব দোকানে শিশুদের খেলনা কিনে দেওয়ার বায়না মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিভাবকদের। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিমান বাহিনী জাদুঘর ও শিশুমেলায়ও ছিল দর্শনার্থীদের ভিড়।
এই দুই জায়াগায় সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত দেখা গেছে শিশুদের। মস্ত বড় বিমান দেখে চোখ ছানাবড়া ক্ষুদে দর্শনার্থীদের। শিশুমেলায়ও বিভিন্ন রাইড দেখে উৎফুল্ল তারা। তবে দুপুরে বৃষ্টির বাগড়ায় কিছুটা ফিকে হয় শিশুদের ঈদ আনন্দ। ঈদের তৃতীয় দিনেও ব্যাপক ভিড় ছিল মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায়। চুতর্থ দিনেও একই অবস্থা। ঢাকাসহ বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এসেছেন দর্শনার্থীরা। বাঘ, সিংহ, সাপ, হরিণ দেখে উচ্ছ্বসিত শিশুরা।
ঈদুল আজহার পরদিন থেকেই বুড়িগঙ্গা ইকো পার্কে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। শহরের কোলাহল ছেড়ে রাজধানীর উপকণ্ঠ শ্যামপুরে প্রায় সাত একর জায়গার ওপর গড়ে উঠা শ্যামপুর বুড়িগঙ্গা ইকোপার্ক যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস। তাই ঈদের ছুটিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে মেতে উঠেছেন অনেকে। বুড়িগঙ্গা পাড়ে নদীর তীরবর্তী গেন্ডারিয়া এলাকায় গড়ে উঠেছে বিনোদন কেন্দ্রটি। যেখানে বিনোদনপ্রেমীরা মেতে উঠেছেন আনন্দে।
পার্কের ম্যানেজার আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, কোরবানির ঈদের দিন খুব বেশি লোকজন না আসলেও পরের দিন লোকজনের আগমন ছিল মোটামুটি। কিন্তু ঈদের তৃতীয় দিন ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। এ দিনের মতো বেশি লোক আসেনি গত দুই দিনে। তিনি বলেন, পার্কটি সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর টিকিট সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পার্কে প্রবেশ টিকিট মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা। আর রাইড উপভোগ করতে চাইলে রাইডভেদে ৫০ ও ৪০ থেকে ১০০ টাকা খরচ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পার্কটি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। এদিন বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে নির্মিত ইকোপার্কে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। এ দিন বিকেল থেকেই বাড়তে থাকে দর্শনার্থীর সংখ্যা।
এদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। মা-বাবার সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাতে এসেছে তারা। ঘুরতে আসা সবার চোখেমুখেই ছিল আনন্দের ছটা। রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা থেকে মাত্র ৭০০ মিটার দূরে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা ইকোপার্ক। এটি শ্যামপুর ইকোপার্ক নামেও পরিচিত। পার্কে বেড়াতে এসে ভেতরের দৃশ্য দেখে শিশুদের মতো অভিভাবকরাও অবাক।
এখানে এমন একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, সেটি তারা জানতেনই না। পার্কে আসা বেশিরভাগ শিশুরই মেরিগো রাউন্ড রাইডটি প্রিয়। এখানেই শিশু-কিশোরদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। এ ছাড়াও সেল্ফ কন্ট্রোল প্লেন, বোটারিকার, রকিং রেট, ক্যাম্পিং প্যাড, কয়েন অপারেটেড বেবি ফিগার এবং ওয়ান্ডার হুইলসহ বিভিন্ন রাইডের সামনেও ছিল তাদের ভিড়।