
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সোনালি ধানের ঝিলিক যেন বাংলার কৃষিনির্ভর ঐতিহ্যের প্রতীক। এ বছর বোরো মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন হয়েছে আশাতীত। কিন্তু মাঠভরা সোনালি ধানও কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষকেরা পড়েছেন চরম হতাশা আর ক্ষতির মুখে।
উপজেলার দক্ষিণ চরআবাবিল, চরপাতা, উত্তর চরবংশীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকের ঘরে ফলন ভালো হলেও বাজারে তার মূল্য নেই বললেই চলে। বর্তমানে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায়, যেখানে উৎপাদন খরচই পড়েছে মণপ্রতি ১,১০০ থেকে ১,২০০ টাকা। ফলে বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ করেও কৃষকেরা মূলধন তুলতে পারছেন না।
جنوب চরআবাবিলের কৃষক আবদুর রশিদ বলেন, “এই মৌসুমে তিন বিঘা জমিতে ধান করেছি। ফলন ভালো, কিন্তু বাজারে দাম শুনে মাথা ঘুরে গেল। প্রতি মণ ধানে প্রায় ৩০০ টাকা করে লোকসান—এভাবে চলতে থাকলে কৃষিকাজে টিকে থাকা কঠিন।”
চরপাতার কৃষক রমজান আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সরকার যে দাম নির্ধারণ করে, তা আমরা পাই না। সরকারি ক্রয়কেন্দ্র শুধু কাগজে-কলমে আছে। বাস্তবে কৃষকেরা সেখানে পৌঁছাতে পারে না। দালাল আর বড় ব্যবসায়ীরাই সব দখল করে রেখেছে।”
রাখালিয়া, বামনী ও উপজেলা সদরের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করছেন। পরে মিল মালিকদের কাছে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করছেন তারা। অথচ মূল উৎপাদক কৃষকই পাচ্ছেন না তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য।
উত্তর চরবংশীর কামাল হোসেন বলেন, “ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেছি। জমি ভাড়া, সেচ, সার, কীটনাশক, শ্রমিক—সব মিলিয়ে খরচ প্রচুর। এখন যদি ধানের দাম না পাই, সংসার চালানোই অসম্ভব হয়ে যাবে।”
আরেক কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, “প্রতি বছর লোকসান হলে চাষ করে লাভ কী? অনেকে বলছে, এবারই শেষ ধানচাষ। সামনে বিকল্প কিছু ভাবতে হবে।”
রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলাম জানান, “সরকার নির্ধারিত দামে (প্রতি মণ ১,৪৪০ টাকা) কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে এবং সিন্ডিকেট রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
তবে কৃষক নেতারা মনে করেন, কেবল ঘোষণায় কোনো লাভ হবে না। প্রকৃত কৃষকদের তালিকা অনুযায়ী সরাসরি তাদের কাছ থেকে ধান কেনার কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে কৃষকেরা কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
স্থানীয় সচেতন নাগরিক মো. সুমন বলেন, “সিন্ডিকেট এখন ওপেন সিক্রেট। কৃষক যে দামে ধান বিক্রি করেন, সেই ধানই বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। লাভ পায় মধ্যস্বত্বভোগী, আর কষ্ট পায় উৎপাদক।”
রায়পুরের মাঠে এখনো ধান শুকানো হচ্ছে, বাতাসে ভাসছে ধানের মিষ্টি সুবাস। কিন্তু সেই সুবাসে নেই আনন্দের ছোঁয়া—বরং ঘনিয়ে আসছে উদ্বেগ, ক্ষোভ আর অনিশ্চয়তা।
কৃষির ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। না হলে ‘ধানভরা গোলা’ হয়ে উঠবে কেবল স্মৃতির প্রতীক। চাষির ঘরে থাকবে না সোনালি ধান—থাকবে শুধু বাকি, বোঝা আর বেদনার দীর্ঘশ্বাস।
নুসরাত