
ছবি : জনকণ্ঠ
নানা কারুকাজে মোড়া দৃষ্টিনন্দন হাতপাখা মানেই কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা নিকলীর অর্ধশত বছরের ঐতিহ্য—দামপাড়া ইউনিয়নের "তালপাখা গ্রাম" খ্যাত সূত্রধরপাড়া, টেকপাড়া ও মালপাড়া। এই এলাকাগুলোতে তালপাতা দিয়ে তৈরি হয় রঙ-বেরঙের বাহারি হাতপাখা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীদের নিপুণ হাতে তৈরি এ হাতপাখাই আজ তিন শতাধিক পরিবারের জীবিকার মূল ভরসা। হাঁসফাঁস করা গরমের ভোগান্তি যেন বাড়তি চাহিদা তৈরি করেছে এই পাখাগুলোর। তাই গ্রীষ্মের তীব্রতায় তালপাখা তৈরিতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন এলাকার বিভিন্ন বয়সের নারী কারিগররা।
ঘরের আঙিনায় বসে তালপাতার হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোররা। কেউ তালপাতা চিরাচ্ছেন, কেউ রঙ করছেন, আবার কেউ বেত দিয়ে পাখায় চাকা বাঁধছেন। প্রতিটি ধাপে ভাগ করা কাজ—একেকজন একেকটি দায়িত্বে। তালপাতা, প্লাস্টিক সূতা, বাঁশ ও বেত—এসব স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা উপকরণ দিয়েই তৈরি হয় বাহারি পাখাগুলো। মায়েদের সঙ্গে মেয়েরাও পড়াশোনার পাশাপাশি হাতপাখা তৈরিতে হাত লাগাচ্ছে, এমনকি পরিবারের পুরুষরাও এই কাজে সহযোগিতা করছেন।
সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প আরও বিকশিত হবে এবং অনেক নারী আত্মকর্মসংস্থানের নতুন পথ খুঁজে পাবেন। তাদের শিল্পকর্ম শুধু ঘর শীতল করে না, সমাজকেও করে আত্মনির্ভর।
প্রায় পাঁচ দশক আগে হাওরপাড়ের নিভৃত এক গ্রামে সূচনা হয়েছিল এক শিল্পযাত্রার, যা আজও বহন করে নারীর সৃষ্টিশীলতা ও সংগ্রামের গল্প। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের টেকপাড়া গ্রামে শুভা রানী সূত্রধরই প্রথম হাতে নেন তালপাতার হাতপাখা তৈরির কাজ। বাবার বাড়ি থেকে শেখা এই শিল্প শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি—দ্বার খুলে দেন গ্রামের নারীদের জন্যও।
তার হাত ধরেই তালপাতার পাখা তৈরি রপ্ত করে ফেলেন টেকপাড়া, মালপাড়া ও সূত্রধরপাড়ার অনেক নারী। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারগুলোর নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই কুটিরশিল্প। এক সময় শখের কাজটি পরিণত হয় জীবিকার অবলম্বনে। ঘরের কোণে বসেই নারীরা তৈরি করতে থাকেন বাহারি হাতপাখা—যা শুধু গরমের সময় স্বস্তি এনে দেয় না, বরং আনে আর্থিক মুক্তির সুবাতাসও।
বর্তমানে শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরাই নয়, মুসলিম পরিবারের অনেক নারীও এই তালপাতার হাতপাখা তৈরির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্প্রদায় ভেদাভেদ ভুলে এই শিল্প হয়ে উঠেছে সব শ্রেণির নারীর আত্মনির্ভরতার প্রতীক।
প্রতি বছর বৈশাখী মেলা ও গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের আগেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে মেলার দোকানিরা ছুটে আসেন এই গ্রামে। কারণ, এখানকার তৈরি তালপাতার হাতপাখার চাহিদা শুধু স্থানীয় পর্যায়ে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। কারুকাজ ও নির্মাণশৈলীর ওপর ভিত্তি করে একটি হাতপাখা পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। প্রতিটি পাখা তৈরিতে গড়ে ৬০ থেকে ৮০ টাকা খরচ পড়ে। এই স্বল্প খরচে নির্মিত হলেও সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তা হয়ে ওঠে নান্দনিক ও বাজারসফল পণ্য।
এই কুটিরশিল্প এখন শুধু অতীতের ঐতিহ্য নয়, বরং বর্তমানের জীবিকার মূল ভরসা হয়ে উঠেছে টেকপাড়া, মালপাড়া ও সূত্রধরপাড়ার শত শত মানুষের জন্য। তালপাতার নিঃশব্দ দোলায় বাজে তাদের আশা, আত্মমর্যাদা আর টিকে থাকার গান।
তালপাতার পাখা তৈরির অভিজ্ঞ কারিগর ঊষা রানী জানান, পাড়ার নারীদের বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে জড়িত এই শিল্পে। যদিও কেউ কেউ সারা বছর অন্য কাজে থাকেন, তবে চৈত্র ও বৈশাখ এলেই সবার হাত ব্যস্ত হয়ে পড়ে তালপাতার পাখায়। গরমের মৌসুম ঘনালেই পাড়াজুড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ—ঘরে ঘরে চলে পাখা তৈরির কর্মযজ্ঞ।
শিক্ষার্থী তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, “পড়াশোনার ফাঁকে মাকে সাহায্য করি পাখা তৈরিতে। এ আয়েই চলে সংসারের কিছু খরচ, বই-খাতার টাকাও জোটে এখান থেকেই।” শিল্পটা তাই শুধু ঐতিহ্য নয়, অনেক পরিবারের ভরসার নামও।
এ বিষয়ে নিকলী উপজেলার নির্বাহী অফিসার পাপিয়া আক্তার জানান, তালপাতার হাতপাখা নির্মাণে নিয়োজিত কারিগরদের সহায়তায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে, পাশাপাশি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে দেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। এছাড়া উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত কুটিরশিল্প মেলায় অংশগ্রহণের জন্য তাঁদেরকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা নিজেদের শিল্পকর্ম প্রদর্শন ও বিক্রির সুযোগ পান।