ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গাইবান্ধায় ফসলের মাঠে পৌঁছায়নি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি

তাসলিমুল হাসান সিয়াম, গাইবান্ধা  

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ১৮ মে ২০২৫

গাইবান্ধায় ফসলের মাঠে পৌঁছায়নি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি

ছবি: সংগৃহীত

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি ব্যবহার কৃষি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেও উত্তরের কৃষি অর্থনীতি নির্ভর গাইবান্ধা জেলার এখনও বহু কৃষক সনাতন পদ্ধতিতেই চাষাবাদ করে যাচ্ছেন। এই প্রথাগত পদ্ধতির ব্যবহারে যেমন সময় বেশি লাগছে, তেমনি প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এতে আর্থিক চাপের মুখে পড়ছেন ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকেরা।

আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে কৃষকদের তেমন ধারণা বা প্রশিক্ষণ না থাকায় এখনও তাদের কাছে কাস্তে আর লাঙ্গল জোয়াল চাষাবাদের একমাত্র ভরসা। এতে করে শ্রম ,সময় অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি উৎপাদন কম হচ্ছে।

মূলত মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের উন্নত কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণে কৃষি বিভাগের নীরব ভূমিকা কৃষি খাতে যন্ত্র ক্রয়ে আর্থিক বিনিয়োগে অনীহা থাকায় অধিকাংশ কৃষক আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ করতে পারছে না।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, স্মার্ট ইরিগেশন, সেন্সর-ভিত্তিক মাটি বিশ্লেষণ, ডিজিটাল কৃষি অ্যাপের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎপাদন বৃদ্ধি খরচ হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু এসব প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ কৃষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় এবং প্রশিক্ষণ আর্থিক সহায়তার অভাবে তারা এগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

সম্প্রতি গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে গত বছরের তুলনায় শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে পাকা ধান মাঠে রেখে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা এমন অবস্থায় অনেক কৃষক কম্বাইন হারভেস্টর মেশিনের সাহায্যে ধান কাটা মাড়াই করার জন্য বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করলেও হারভেস্টর মেশিনের নাগাল পাচ্ছে না। কারন জেলার চাহিদার তুলনায় হারভেস্টর মেশিনের সংখ্যা খুবই সীমিত।

চলতি বছরে গাইবান্ধা জেলার সাত উপজেলায় বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হলেও শ্রমিক সংকটে মাঠ থেকে ধান সংগ্রহ করতে পারছে না অধিকাংশ কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে জেলায় লক্ষ ২৯ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে এবং ১৩ মে বুধবার পর্যন্ত মোট ৬৮ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, জেলায় গত কয়েক বছরে সরকারি ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া কম্বাইন হারভেস্টরের সংখ্যা মাত্র ১৪১ টি এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২১ টি , সাদুল্লাপুরে ২১ টি, পলাশবাড়ী ১৩ টি , গোবিন্দগঞ্জে ৪৫ টি , সুন্দরগঞ্জে ২০ টি , সাঘাটা ১৪টি ফুলছড়িতে ১৪ টি মেশিন বিক্রি হয়েছে। এসব হারভেস্টর মেশিনের মধ্যে সচল আছে ১১৫ টি অচল হয়ে পড়ে আছে ২৬ টি অন্যদিকে ধান কাটার রিপার আছে ১২ টি রিপার বাইন্ডার আছে ১৪ টি , রাইস প্লান্টার আছে মাত্র টি

সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের কৃষক মাহবুবুর রহমান বলেন,গত তিন দিন থেকে ধান কাটার শ্রমিক খুঁজেও পাচ্ছি না এদিকে মাঠে পাকা ধান পড়ে আছে। আমাদের গ্রামে এখন পর্যন্ত ধান কাটা মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র আসেনি বাধ্য হয়ে কাস্তে দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে।

কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, "দাদার সময়ে যেমন চাষ হতো, এখনও তেমনই করছি। আমরা শুনেছি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে সরকার ভর্তুকি দেয়, কিন্তু কে পাচ্ছে, সেটা জানি না। জমি কম, টাকার অভাবে যন্ত্র কিনতে পারি না।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নাকাই ইউনিয়নের কৃষক সোবহান মন্ডল জানান, " আমি ১২ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি গতবছরের তুলনায় বছর শ্রমিকদের মজুরি ১০০ টাকা বেড়ে ৭০০ টাকা হয়েছে। সুতরাং এক বিঘা জমির ধান কাটতে আমার প্রায় ৪২০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা লাগছে এরপরেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া উৎপাদন খরচের পরিসংখ্যানে জানা যায় এক হেক্টর জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে ধান চাষে খরচ হয় গড়ে ৫৮,০০০ টাকা, যেখানে আধুনিক যন্ত্রনির্ভর পদ্ধতিতে একই জমিতে খরচ হয় প্রায় ৪৫,০০০ টাকা। এর মধ্যে শ্রমিক খরচই বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ, কারণ যন্ত্রের পরিবর্তে হাতের কাজের ওপর নির্ভর করতে হয় কৃষকদের।ফলনের পরিমান বিশ্লেষণে দেখা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে গড়ে ধান উৎপাদন হচ্ছে . মেট্রিক টন, যেখানে আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদন হয় . থেকে মেট্রিক টন পর্যন্ত। অর্থাৎ ফলন কম, কিন্তু খরচ বেশিএতে কৃষকের লাভের হার কমছে।

পলাশবাড়ী উপজেলার পবনাপুর ইউনিয়নের হারভেস্টর মালিক আব্দুল মাজেদ বলেন , বর্তমানে এক বিঘা জমির ধান কাটা মাড়াইয়ে শ্রমিক খরচ সাড়ে চার হাজার টাকা অন্যদিকে হারভেস্টরে খরচ হাজার ৩০০ টাকা হারভেস্টরে প্রতি একর জমির ধান কাটতে সময় লাগে মাত্র ঘন্টা। সার্বিক বিষয় চিন্তা করলে মানুষের তুলনায় যন্ত্রটির সময় অর্থের অপচয় হয় কম হয় মেশিনটি নিয়ে এখনো অনেক মানুষের কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যদি কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এই মেশিনটি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হয় হয় তাহলে কৃষক আমাদের মতো কৃষি উদ্যোক্তারা উভয়েই লাভবান হতে পারব

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে আমরা মাঠপর্যায়ে নিয়মিত উঠান বৈঠক করছি এছাড়া প্রতিবছর কৃষি মেলায় হারভেস্টরসহ বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তির প্রদর্শনীর আয়োজন করা সেখান থেকেও কৃষি উদ্যোক্তাদের এসব যন্ত্র ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

গাইবান্ধা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহবুবার রহমান বলেন, “বর্তমান সময়ে কৃষিকে লাভজনক করতে হলে যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। সনাতন পদ্ধতিতে কৃষক শুধু বেশি খরচই করছেন না, বরং উৎপাদনের হারও কম পাচ্ছেন।” তিনি আরও জানান, সঠিক প্রশিক্ষণ সরকারি সহায়তা ছাড়া প্রান্তিক কৃষকরা কখনোই প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারবে না।সনাতন পদ্ধতির কৃষি কার্যক্রম দেশের খাদ্য উৎপাদনে এখনও ভূমিকা রাখলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষকদের জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং কৃষিকে আরও লাভজনক করতে হলে যান্ত্রিকীকরণ, প্রশিক্ষণ সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। নতুবা ক্ষুদ্র কৃষকেরা কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অশনিসংকেত।

মুমু

×