
ছবি: জনকণ্ঠ
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, প্রযুক্তির ব্যবহার ও সেবার মানসিকতা—এই চার মূলনীতিকে সামনে রেখে পাল্টে গেছে এক সময় দালালচক্রের দৌরাত্ম্যে ভরা জেলার গৌরনদী উপজেলা ভূমি অফিসের চিত্র। ভূমি অফিস মানেই একসময় ছিল হয়রানি, অতিরিক্ত টাকা আদায় ও দালালের দৌরাত্ম্য—এই নেতিবাচক ধারণাগুলো ভেঙে দিয়েছেন এক জন সহকারী কমিশনার (ভূমি)।
বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাত মাস আগে গৌরনদী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগ দেন মো. রাজিব হোসেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানামুখী কৌশলে তিনি ভূমি অফিসকে দালালমুক্ত করে সেবা কার্যক্রম গতিশীল করে তোলেন।
তার অন্যতম উদ্ভাবন “এক দিনে আবেদন, এক দিনে নামজারি” কর্মসূচি ইতোমধ্যে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নিয়মিত নামজারির আবেদন নিষ্পত্তি ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি এই ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক নামজারি সম্পন্ন করা হয়েছে।
অফিসে চরম জনবল সংকট থাকা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় এনেছেন এবং অনিয়মে জড়িতদের শাস্তিমূলক বদলির আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছেন।
ফলে গৌরনদী ভূমি অফিস এখন আর হয়রানির জায়গা নয়, বরং সেবাগ্রহীতাদের কাছে আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজিব হোসেন যোগদানের পর ছয়জন তহশিলদার ও দুইজন কর্মচারীকে শাস্তিমূলকভাবে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। সর্বশেষ আব্দুর রহিম নামের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বদলি এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এছাড়া অভিনব কৌশলে এ পর্যন্ত ছয়জন দালালকে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে একজনকে দণ্ড প্রদান করা হয় এবং বাকিরা মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছে। নামজারির ক্ষেত্রে কেউ অতিরিক্ত টাকা নিলে তা ফেরত দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজিব হোসেনের উদ্যোগে দখলদারদের হাত থেকে প্রায় ৩০ একর সরকারি জমি উদ্ধার করা হয়েছে এবং পৌনে এক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, "নামজারির জন্য এক দালাল আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়, কিন্তু কাজ করতে পারেনি। এসিল্যান্ড স্যারকে জানালে, তিনি আমার টাকা উদ্ধার করে নামজারিও করে দিয়েছেন।"
সুন্দরদী গ্রামের স্বরস্বতি দাস বলেন, "আগে ভূমি অফিসে গেলে নিচতলায় দালালের আনাগোনা দেখা যেত। এখন আর সেই চিত্র নেই। এখন নিজেরাই সরাসরি এসিল্যান্ড স্যারের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত কাজের সমাধান পাচ্ছি। এতে অর্থ সাশ্রয় ও ভোগান্তি কমেছে।"
অন্যদিকে সেবার মান বেড়ে গেলেও, অতীতের দালাল চক্র ও এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারীদের মধ্যে চরম অস্বস্তি দেখা দিয়েছে।
সূত্র মতে, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে পাঁচজন অফিস সহকারীর পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র একজন। অফিস সহায়কের দুটি পদই শূন্য। সার্ভেয়ারের দুটি পদের বিপরীতে কর্মরত একজন।
এ প্রসঙ্গে সহকারী কমিশনার মো. রাজিব হোসেন বলেন, "এক সময় দালালরা একটি নামজারির জন্য পাঁচ থেকে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত নিত। এমনকি কাগজপত্র ঠিক থাকলেও অফিসে টাকা না দিলে কাজ হতো না। বিষয়টি অনুধাবন করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সহায়তায় সম্পূর্ণ দালালমুক্ত একটি ভূমি অফিস গড়ে তোলা হয়েছে।"
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিফাত আরা মৌরি বলেন, "উপজেলার মধ্যে ভূমি অফিস দুর্নীতিমুক্ত অফিস হিসেবে গর্ব করতে পারে। জনবল সংকট বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে, দ্রুত সমাধানের আশা করছি।"
বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, "স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতিমুক্ত সেবার দিক থেকে গৌরনদী উপজেলা ভূমি অফিস জেলার সেরা। অন্য উপজেলাগুলোর জন্য এটি একটি উদাহরণ। জনবল সংকটের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।"
শহীদ