
ভাতিজিকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। তাই সকালে সকাল মোটরসাইকেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী ভাতিজি,স্ত্রী ও দুই বছরের সন্তানকে নিয়ে আশরাফুল ইসলাম বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিলেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌছানোর আগেই যাত্রীবাহী বাসের চাপা। ভাগ্যক্রমে মোটরসাইকেল চালক আশরাফুল আহত হয়েও বেঁচে গেলেও স্ত্রী রুবিনা বেগম (৩২), তাদের ছেলে রহমত আলী (২) ও ভাতিজি এসএসসি পরীক্ষার্থী আফছানা বেগম স্নেহা (১৬) ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ছিল মঙ্গলবার (১৩ মে) সকালে রংপুরের কাউনিয়ায়। এ ঘটনায় নিহতদের গ্রামে শোকের মাতন দেখা যায়।
স্থানীয়রা জানান, রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের মহেশা গ্রামের মোকলেছুর রহমানের তিন ছেলের মধ্যে বড় আনারুল। এরপর আশরাফুল। আনারুল ও আশরাফুল কাউনিয়ার মীরবাগ বাজারে যৌথভাবে লন্ড্রি ও সুতার দোকান পরিচালনা করেন।আনারুল ইসলামের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে হাফেজ। মেয়ে স্নেহা মীরবাগ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। আজ ছিল তার বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষা। ছোট মেয়ে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এদিকে, আশরাফুল ইসলামের তিন ছেলের মধ্যে বড় দুই ছেলে রায়হান (১৫) ও রাহাত (১১) হাফিজিয়া মাদরাসার ছাত্র। দুই বছর বয়সের ছোট ছেলে রহমতকেও হাফেজ বানানোর ইচ্ছে ছিল আশরাফুলের। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল কাদের বলেন, আশরাফুল ও আনারুল- দুই ভাই তাদের ছেলেদের হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করাচ্ছেন। হঠাৎ এমন দুর্ঘটনায় সবকিছু চুরমার হয়ে গেল।
স্নেহার সহপাঠী ওই গ্রামের মোসলেমা আক্তার মুক্তা বলেন, স্নেহা খুব উদার মনের একটা মেয়ে ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে হাসিখুশিতে থাকতো সবসময়। তার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। মীরবাগ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক আফরোজা বেগম বলেন, স্নেহা অত্যান্ত মেধাবি ছিল। তাকে ঘিরে আমরা শিক্ষকরা আশাবাদী ছিলাম। লেখাপড়া শিখে সে জীবনে ভালো কিছু করতে পারতো- এই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু অকালেই ঝরে গেলো সব আশা।
দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আহত আশরাফুল ইসলাম জানান, ভাতিজিকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে উপজেলা সদরে মোফাজ্জল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার সময় মীরবাগ বেইলি ব্রিজ পার হয়ে কৃষি কলেজের সামনে পৌঁছালে তার মোটরসাইকেলের সামনে থাকা একটা দ্রুত গতির মাহিন্দ্র গাড়ি হঠাৎ ব্রেক ধরে। এসময় তিনি মোটরসাইকেলটি থামানোর চেষ্টা করেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ায় মোটরসাইকেলটি পিছলে সড়কে পড়ে যান। পরে তিনি রাস্তার পাশ থেকে উঠে দেখেন একটি যাত্রীবাহী বাস তার স্ত্রী, সন্তান ও ভাতিজির ওপর দিয়ে চালিয়ে পালিয়ে যায়। তারা তিনজন সেখানেই মারা যান।
নিহত স্নেহার বাবা আনারুল ইসলাম বলেন, একমাত্র ছেলেকে হাফেজ বানিয়েছি। বড় মেয়ে স্নেহা ছোট থেকে মেধাবি ছিল। তাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। ভাবছিলাম ডাক্তার হবে মেয়ে। এভাবে সব তছনছ হয়ে যাবে ভাবতে পারছি না।
কাউনিয়া থানার উপপরিদর্শক শাহানুর জানান, সকাল ৯টার দিকে স্ত্রী, সন্তান ও এসএসসি পরীার্থী ভাতিজিকে নিয়ে মোটরসাইকেলে উপজেলা সদরে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন আশরাফুল। জুম্মারপাড় কৃষি কলেজের সামনে পৌঁছালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলটি পড়ে গেলে তিন আরোহী রাস্তার উপরে ছিটকে পড়েন। এসময় বিপরীত দিক থেকে আসা অজ্ঞাত একটি বাস রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা মোটরসাইকেলের তিন আরোহীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান। রাস্তার পাশে পড়ে যাওয়ায় আহত হন মোটরসাইকেল চালক আশরাফুল।
স্থানীয় মিলন, মিজান, আসলাম বলেন, দুই লেনের আঞ্চলিক মহাসড়কে স্বল্প ও দ্রুত গতির ছোট ছোট গাড়িগুলো চলাচলের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় বাসচাপায় স্বামী বেঁচে গেলেও চলে গেল তিনটি প্রাণ। আমরা এমন দুর্ঘটনা দেখতে চাই না। দুর্ঘটনা রোধে আঞ্চলিক মহাসড়কে ছোট ছোট গাড়ি চলাচল বন্ধের দাবি জানান তারা। পাশাপাশি তারা জানান, এক মোটরসাইকেলে এ ভাবে চারজন যাওয়া সঠিক ছিলনা। এই ভুল আর যেন না করেন।
রাজু