
থার্ড টার্মিনালের কার্গোতে ত্রুটি!
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য রাখতে হয় একটি সুিনর্দিষ্ট ওয়ার হাউজে। পণ্যের বার কোড না থাকলে সেগুলো স্থানীয়ভাবে তাৎক্ষণিক বার কোড দিয়ে খালাস করতে হয়। কিন্তু নবনির্মিত কার্গোতে নেই এ সুবিধা। একইভাবে বোয়িং ৭৪৭ এর প্লেটের সাইজ ১৬ থেকে ২০ ফুট দৈর্ঘের। কিন্তু নতুন কার্গোতে যে স্টোরেজ করা হয়েছে. তার পরিমাপ ১৪ ফুট। ফলে বড় উড়োজাহাজের প্লেট এখানে হ্যান্ডেল করা যাবে না।
আবার কোনো পণ্য ছাড়ের আগে কাস্টমস সেগুলোর এসেসমেন্ট করে থাকে এক্সেস এরিয়ায়। অথচ এ স্পেসও রাখা হয়নি। এ রকম একটি দুটো নয়, কমপক্ষে ৯টি বড় ধরনের ভুল ত্রুটি রয়েছে থার্ড টার্মিনালের আমদানি ও রপ্তানি কার্গোতে। এসব ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়েছে খোদ বিমানের অনুসন্ধানে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রাথমিকভাবে এই কার্গো দুটোর অপারেট করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার আগে সরেজমিন পর্যবেক্ষণে এ ধরনের ত্রুটি শনাক্ত করেছে। এগুলো সংশোধন না করে কার্গো ভবন চালু করতে গেলে বিমানকে কি ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে সেটা উল্লেখ করে ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ে বিশেষ প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
এর পর বেবিচকও সেগুলোর সত্যতা পেয়ে কিছু সংশোধন করা ও বিকল্প উপায় বের করার সিদ্বান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে চলছে তোলপাড়। হাজার হাজার কোটি টাকার এমন প্রকল্পে কি করে এত ভুল ত্রুটি করা হলো, কারা এ জন্য দায়ী এটাই এখন বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, দুহাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কার্গো ভবন দুটোতে কেন এমন ভুলত্রুটি হলো? এজন্য কারা দায়ী? কিভাবেই সামাল দেওয়া হবে অত্যাধুনিক এই কার্গো।
প্রশ্ন করা হলে বিমান উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘আমি এখনো দেখিনি বিমানের প্রতিবেদনটি। দেখার পর বলতে পারব।
জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুরুল কবীর ভুইঞাও কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে জনকণ্ঠকে যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন,্ চার বছর আগে কিভাবে কারা প্লানিং ডিজাইন করেছে, তা তো তার পক্ষে বলা বা খ-ানো সম্ভব নয়। আগের ভুলের কৈফিয়ত এখনকার লোকজন কেন দেবে? তার পরও আমরা চেষ্টা করছি, যতটা সম্ভব এ সবভুল-ত্রুটি শুধরিয়ে কাজ শুরু করে দেওয়া।
যেমন স্টোরেজে যে প্লেট না ঢুকানো যাবে সেগুলোর জন্য আলাদা স্পেস তৈরি করে সেখানে বিকল্প উপায়ে রাখা। কিছু কিছু নতুন করে তৈরি করতে হবে। এভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কাজ চলছে। আশা করছি এটা বড় ধরনের সংকট তৈরি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এয়ার ভাইস মার্শাল জার্মান এয়ারপোর্টের উদাহরণ টেনে বলেন, সেটা উদ্বোধনের আগের রাতে ২০ হাজার ত্রুটি ধরা পড়ে। তারপর সেগুলো সংশোধন করেই জার্মান এয়ারপোর্ট চালু করা হয়েছে। একইভাবে হিথরোসহ বিশ্বের আরও ৪/৫টা এয়ারপোর্ট চালুর আগে এ ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ে। আসলে এ ধরনের বড় প্রকল্পের শুরুতে কিছু বোঝা না গেলেও পরে ট্রায়ালের সময় সেগুলো শনাক্ত করা যায়। আমাদের কার্গোতে তো তেমন বড় কিছু ত্রুটি ঘটেনি।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বিমান তাদের কার্গো ভবন দুটোর বিষয়ে ত্রুটি বিচ্যুতি উল্লেখ করে সিভিল এভিয়েশন ও মন্ত্রণালয়ে পৃথক পৃথক চিঠি দিয়েছে। তারা যেহেতু এই কার্গো দুটো অপারেট করার দায়িত্ব পাচ্ছে, তারা সেভাবে প্রস্তুতি নিচেছ দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার, সেহেতু সুবিধা অসুবিধার কথাটা তাদের চোখেই বেশি পড়বে। আমরাও তাদের সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি।
আমরা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কোম্পানি এডিসিসহ জাপানিজদের নিয়ে বৈঠক করেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছে, যতোটা পারা যায়, সংশোধন করা। তবে কিছু বিষয় আছে, যেগুলো হয়তো নতুন করে করা যাবে না। যেমন- বড় উড়োজাহাজের পেলেটগুলো এখনকার মতো পুরানো কার্গো ভবন দিয়েই ম্যানুয়ালী হ্যান্ডেল করতে হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপানের প্রযুক্তিতে জাপানের মতোই নির্মাণ করেছে এই কার্গো। জাপানের বিমানবন্দরের অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত যেই সুবিধা অনায়াসে পাওয়া যায়, ঢাকায় সেটা দুর্লভ। যেমন জাপানের নারিতা কিংবা হানাদা এয়ারপোর্টের আমদানি কার্গোর পণ্য বিমানবন্দরের বাইরে আলাদা বন্ড হাউজে রাখে।
সেখান থেকে পণ্য সরবরাহ করা হয় । কিন্তু ঢাকার নবনির্মিত এই সুবিধা নেই। নবনির্মিত কার্গো হাউজের জন্য ডেডিকেটেড বন্ড হাউজ নেই। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়ার হাউজ থাকলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ অপর্যাপ্ত। ফলে আগের মতোই কার্গোর বাইরে পণ্যে স্তুুপ থাকবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
এ ছাড়াও রয়েছে বিশ্বমানের প্রযুক্তির সম্পন্ন এই কার্গোর অপারেট করার সক্ষমতা ঘাটতি। ঢাকায় নিয়মিত কার্গো ফ্লাইট অপারেট করে এমন একটি বিদেশী এয়ারলাইন্সের স্থানীয় জিএসএর অভিযোগ- এটা শতভাগ রোবটিক ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) নির্ভর। যা বাংলাদেশ তো নয়ই- গোটা এশিয়াতে এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কোন কার্গো ভবন নেই। বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটা এয়ারপোর্টে এ ধরণের কঠিন ও জটিল প্রযুক্তি রয়েছে, যেগুলো অপারেটিং হ্যান্ডলিং করছে সুইজ পোর্ট ও ডানাটার মতো বিশ্বমানের কোম্পানী।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষে এ ধরণের কার্গো হাউজ অপারেট করার সক্ষমতা কতখানি রয়েছে- সেটাই এখন নির্ণয় করা জরুরি। নইলে পুরানো এয়ারপোর্টের মতোই এখানেও বির্তকের মুখে পড়তে হবে বেবিচক ও বিমানকে। হাজার হাজার কোটি খরচ করে এ ধরণের কার্গো নির্মাণ করে , শুধু একটি শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের অভাবে সব আয়োজন মুখ থুবড়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এগুলো এখনই সমাধান করার উপযুক্ত সময়। তা না হলে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।
বিমানের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে দৈনিক আকাশপথে প্রায় ৪ থেকে ৫ শত টন কার্গো পণ্য আসে হজরত শাহজালাল আন্তজার্তিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো দিয়ে। তার বেশীর ভাগই গার্মেন্টেসের ফেব্রিকস রোল যেগুলো বেশ লম্বা। এধরণের পণ্য নতুন কার্গোতে রাখার কোন স্পেশ নেই।
ফলে আগের মতোই কার্গোর সামনে খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে হবে। তাতে বিশ্ঙৃখলা ও জটিলতা দেখা দিবে। একইভাবে ওষুধ প্রস্তুতকারী ফার্মাসিউটিক্যাল তরল কাচামাল বড় ড্রামে করে আনতে হয়।যেগুলো রেকে রাখার নিয়ম থাকলেও নতুন কার্গোতে সে সুযোগ রাখা হয়নি।
এ কার্গো ভবনে তৈরি করা হয়নি কুল রুম (হিমাগার) যেখানে মানুষের মরদেহ ও আমদানিকৃত ওষুধের কাচামাল একটা সুিনর্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ রাখা হয়। ্এ অবস্থায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং অপারেটর হিসেবে বিমানকে অনেক বড় খেসারত দিতে বা ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
এখানে নেই অটোমেটেড স্টোরেজ এন্ড রিট্রিট সিস্টেম (এএসআরএস)। মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য যেগুলো হস্তান্তর প্রক্রিযার বিভিন্ন ধাপে মূল কোড নষ্ট হওয়া ছিড়ে যায। সেইপণ্যগুলোকে কার্গো ভবনেই নতুন করে লোকাল বার কোড সংযুক্ত করতে হয় ।কিন্তুু এই কার্গো এ সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে অনেক পণ্য যদি কেউ ইচেছ করে নষ্ট করে সেগুলোর লোকাল বার কোড দেয়া সম্ভব হবে। তাতে আমদানীকারকের সঙ্গে অবৈধ উপায়ে বার্গেনিং করে খালাসের সুযোগ থাকবে।
এখানে নেই স্টাফরুম। প্রতি শিফটে কমপক্ষে এই কার্গোতে ৩/৪ শ কর্মচারি কর্মকর্তা ডিউটি করতে হবে। তাদের জন্য মাত্র দুটো টয়লেট তৈরি করা হয়েছে। অনেক সময় ওভারটাইম করতে হয় স্টাফদের। তাদের ড্রেস চেনঞ্জ করার দরকার হলেও সেটা সম্ভব হবেনা।
দেশের শীর্ষ রফতানিকারকদের অভিযোগ, এয়ার কার্গো সাধারণত দু ধরণের- ফ্রেইট ও বেলী। ডেডিকেটেড কার্গো ফ্লাইটে করে যে পণ্যগুলো আসে সাধারণত সেগুলো বেশীরভাগই বোয়িং ৭৪৭ এর মতো সুপরিসর ফ্লাইটে। যার কার্গো প্লেটের সাইজ হচেছ- ১৬ থেকে ২০ফুটের। নতুন কার্গোর ব্রেকডাউন হচেছ-১৪ ফুট দৈর্ঘের। কাজেই এখানে ওভারসাইজ কার্গো হ্যান্ডলিং করার সুযোগ নেই।
সেগুলো হয় বাইরে ফেলে রাখতে হবে, নইলে ওজন ও স্ক্যানিং ছাড়াই প্রক্রিয়া করতে হবে। ওভারসাইজড প্লেট রাখারও কোন সুবিধা রাখা হয়নি এখানে। আরও নেই ওয়ারহাউজ সুবিধা। নেই বিদেশী পোস্টাল মেইল,ডিপ্লোমেটিক মেইল, ও কুরিয়ার মেইলের জন্য কোন বিশেষায়িত স্পেস রাখা হয়নি। যা এ ধরণের একটি আন্তজাতিক মানের কার্গো হাউজে থাকাটা আবশ্যিক।
একইভাবে রফতানি কার্গোতেও অনেক সুবিধা নেই। যেমন এখানে পণ্যের ওজন মাপার সুযোগ রাখা হয়নি।
এখানকা স্টোরেজের উচ্চতা হচেছ- ১১৪ ইঞ্চি। যেখানে মেইন ডেক প্লেটের উচ্চতা হচেছ- ১১৮ইঞ্চি। ফলে এগুলোতে সংকট দেখা দেবে। আরও নেই শুন্য ইএলডি রাখার স্টোরেজ। এখানেও নেই কাষ্টমস অনুবীক্ষনের সুবিধা।
বিমান সূত্র জানিয়েছে- এত অত্যাধুনিক মানের এত ব্যয়বহুল কার্গো ভবন দুটো অত্যাবশকীয় এসব সুবিধা না থাকায় বড় ধরণের বিশ্ংৃখলা ও ভোগান্তির মুখে পড়তে হবে অপারেটরদের। এতে করে কাজের সময় ও ব্যয় দুটো বাড়বে।
এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল হক বলেন, এটা তো আমাদের জাতীয় সমস্যা বা রোগ। যার জন্য কার্গো ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যারা এটা ব্যবহার করবে, যারা ্এটা অপারেট করবে, তাদেরকে বাদ দিয়ে বেবিচক একক সিদ্বান্তে এ ধরণের পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারা স্টেকহোল্ডারদে সঙ্গে শলা পরামর্শ না করে চেয়ারে বসে একটা প্লান করে দিয়েছে., আর জাপানীজও এ দেশের সার্বিক পরিবেশ বিবেচনায় না নিয়ে তাদের দেশের উন্নত পরিবেশ ও সুবিধার কথা মাথায় রেখে এটা নির্মান করেছে।এখন যখন বিমান কার্গো হ্যান্ডলিং হিসেবে অপারেট করার প্রস্তুতি নিচেছ ঠিক তখনোই তাদের নজরে এ ধরণের ভুলত্রুিিটগুলো ধরা পড়ছে। আমিও নিজেও যা শুনছি তাতে তো উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে হচেছ।
তিনি বলেন- আমরা পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ গার্মেন্টস ও ওষুধ রফতাকিকারক দেশ। এখানকার কার্গোর ভলিয়ম অনেক বড়। আমাদের রয়েছে কার্গো হাব করার মহাপরিকল্পনা। এখনোই কার্গোর যে ব্যাপ্তি রয়েছে বিশ্বব্যাপী তাতে আগামী এক দশকেই সেটা কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটা সহজেই অনুমেয়। অথচ এমন বিপুল সম্ভাবনার কার্গো যদি ওষুধ রফতারি জন্য বিশেষ হিমাগার না থাকে তাহলে তো পণ্যের গুনগত মান হুমকিতে পড়বে। এধরণের আরও অনেক ভুলত্রুটি রয়েছে। যেগুলো এখনই উপযুক্ত সময়, জরুিির ভাবে সবাইকে নিয়ে বসে এগুলোকে সংশোধন করে দ্রুত অপারেশন যোগ্য করে তোলা। ন্ইলে সব আয়োজন বৃথা যাবে।
হজরত শাহজালাল আন্তজার্তিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশী ব্যয়ে দুটো-এক্সপোর্ট ও ইমর্পোট কার্গো ভবন তৈরি করা হয়। এর মধ্যে রফতানি কার্গোর বার্ষিক ৫ লক্ষাধিক টন পণ্য রফতানির সক্ষমতা রয়েছে। আমদানি কার্গোতেও বার্ষিক ২ লক্ষাধিক টন পণ্য পাঠানোর সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান দুটো কার্গো ভবন দিয়ে দৈনিক ৬ থেকে ৭ শত টন পণ্য রফতানি ও ৪থেকে ৫শত টন পণ্য আমদানী করা হচেছ।