ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

দূর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি প্রকল্প

চার বছরের প্রকল্প আট বছরেও শেষ হয়নি; ফের বাড়ছে মেয়াদ

জাহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১২:১১, ৭ মে ২০২৫

চার বছরের প্রকল্প আট বছরেও শেষ হয়নি; ফের বাড়ছে মেয়াদ

* ২০২১ সালে শেষ হওয়া কথা, কিন্তু এখনও চলমান 
* ফের এক বছর সময় চেয়েছে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর
* ৪৬৬ কোটি টাকা থেকে ব্যয় ৬২০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে  
* বিলম্বে কারণ হিসেবে সরকারি ক্রয় নিষেধাজ্ঞা দেখানোর অপকৌশল
* আরেক প্রকল্প দেড় দশকেও শেষ করতে পারেনি রাজউক

যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ভবন ও অবকাঠামো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, দূর্যোগকালে দ্রুত সাড়া ও শক্তিশালী উদ্ধার কার্যক্রম এবং দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে জরুরী যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ‘দূর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি’ প্রকল্প হাতে নেয় দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। চার বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন মাসে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ৮ বছর পরও চলছে প্রকল্পটি কার্যক্রম। উপরন্তু এই সময়ে এসে ফের প্রকল্পটি মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে অধিদপ্তর থেকে, যা বুধবার অনুষ্ঠিতব্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে। এমনটাই জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।

সূত্র জানায়, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এই প্রকল্পটি ৩য় বারের মতো সংশোধনী দিয়ে একনেক সভায় উপস্থাপন হতে যাচ্ছে। প্রকল্পটির মূল অনুমোদতি ব্যয় ৬২০ কোটি ২২ লাখ টাকা ধরা হলেও দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় কমিয়ে ৪৬৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। কিন্তু উপস্থাপন হতে যাওয়া তৃতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পটিতে ফের ৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হচ্ছে। একইসঙ্গে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২য় সংশোধনীতে ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রস্তাবিত ৩য় সংশোধনীতে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়েছে।

এই সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে সংস্থাটি জানায়, অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় জলযানসহ যে কোন যানবাহন ক্রয়ে বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে প্রকল্পের আওতায় কম্পোনেন্ট-২ এর অগ্রগতি মাত্র ১০ শতাংশ। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জলযান ক্রয়ের অনুমতি পাওয়া গেছে। ফলে উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য ১২টি স্পিডবোট ক্রয়ে দরপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এর আওতায় স্পিডবোট সংগ্রহে ১২-১৫ মাস সময় লাগবে। তাই মেয়াদবৃদ্ধি প্রয়োজন। 

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় কৃচ্ছতাসাধনের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে যে কোন সরকারি যানবাহন ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ প্রকল্পটির মূল বাস্তবায়ন মেয়াদ ২০২১ সালের জুন মাস অতিক্রমের প্রায় ২ বছর পর এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ফলে স্বাভাবিক বিবেচনায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গাফেলতি প্রতীয়মান হয়।

জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তা বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পপির প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প ঋণ হিসেবে জাইকার অর্থায়ন ৪০৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং সরকারি অর্থায়ন ৯৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। জুন ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ২৭৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বা ৫৯ দশমিক ২৯ শতাংশ, যেখানে বাস্তব অগ্রগতি বলা হয়েছে ৭০ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (আরএডিপি) ৮৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। 

জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৩টি বিভাগের ১২টি জেলার ৩৫টি উপকূলীয় উপজেলা এবং বন্যাপ্রবণ দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোন ও জামালপুরসহ দেশের মোট ৮টি বিভাগের ৩৫ জেলার ১০১টি উপজেলায় দূর্যোগকালে উদ্ধার কার্যক্রম ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে অবকাঠামো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে দূর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রকল্পটি নেয়া হয়। 

প্রকল্পটির আওতায় প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পানি উন্নয়নের বোর্ডের অধীনে ১০টি উপজেলায় বেড়ীবাঁধ ও সেচ অবকাঠামো মেরামত এবং সংস্কার, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অধীনে ৫৯টি উপজেলায় গ্রামীন রাস্তা মেরামত ও সংস্কার, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় ৪টি উপজেলায় গ্রামীন পাকা রাস্তা মেরামত ও সংস্কার এবং টেলিযোগাযোগ, অগ্নিনির্বাপক, রেডিও সরঞ্জামাদি, জলযান, তাবু এবং মোটর যানবাহন ইত্যাদি উদ্ধার সহায়ক যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং উদ্ধার জলযান ক্রয়।

৩য় সংশোধনের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, দেশের দূর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় ও নদী ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকায় জানমাল ও সম্পদ রক্ষা পাবে। এছাড়া গ্রামীন এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্যোগের সময়ে জরুরী যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে বিধায় প্রকল্পটির ৩য় সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, শুধু এই প্রকল্পটিই নয়, সংশোধনের জন্য আরো ৩টি প্রকল্প উপস্থাপন হচ্ছে যাচ্ছে একনেক সভায়। এমনও প্রকল্প আছে যেটি মূল অনুমোদিত মেয়াদের এক যুগ পরও শেষ করা যায়নি। ২০১০ সালে জুলাইয়ে শুরু হওয়া গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পটি এখনও চলমান। এর মধ্যে প্রকল্পটির ব্যয় ৪১০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৫৫৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১ম সংশোধনীতে প্রকল্প সমাপ্তের মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

সভায় ৩টি সেক্টরের মোট ১১টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এর মধ্যে নতুন প্রকল্প ৪টি, সংশোধিত ৪টি এবং মেয়াদবৃদ্ধির জন্য ৩টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে ৪টি, প্রকল্প অনুদান ১টি, প্রকল্প ঋণ ২টি এবং সরকার ও সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১টি প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে। 

একনেক সভায় উপস্থাপন হতে যাওয়া বাকি ৯টি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন সচিবালয়ের ৭টি আঞ্চলিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প (প্রস্তাবিত ৩য় সংশোধিত), প্রিভেনশন অফ ভায়োলেন্স অ্যান্ড হার্মফুল প্র্যাকটিস এগেইনেস্ট চিলড্রেন অ্যান্ড ওমেন ইন বাংলাদেশ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ স্থাপন, নারায়নগঞ্জের খানপুরে অভ্যন্তরীন কন্টেইনার এবং বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ (১ম সংশোধিত), বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি, ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যন্ড রেসপন্স প্রজেক্ট (বি-স্ট্রং) (ডিডিএম পার্ট), খুলনা সাতক্ষিরা বাগেরহাট জেলার সেচ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রকল্প, ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহন, খুলনা শিপইয়ার্ডের সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন (২য় সংশোধিত) এবং জাতীয় চিত্রশালা-জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র সম্প্রসারণ ও অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ (১ম সংশোধিত)।

নুসরাত

×