
তিস্তার চরে কাঁচা সোনাখ্যাত ভুট্টার কাটাই-মাড়াই কাজে ব্যস্ত চরবাসী
শুরু হয়েছে ভুট্টা মৌসুম। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের রংপুর অঞ্চলের তিস্তাপাড়ের চরের জমিতে চলছে ভুট্টা কাটা-মাড়াইয়ে ধুম। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ভুট্টার ঘ্রাণ আর কৃষকের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। মাঠজুড়ে যেন এক প্রাণবন্ত উৎসব।
কালের স্রোতে পাল্টে গেছে তিস্তা অববাহিকা। হারিয়েছে তার ভয়াল যৌবন। নদীর করাল গ্রাসে হাজার হাজার পরিবার আবাদি জমি, বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এই নিঃস্ব পরিবারগুলো বাঁচার তাগিদে তাদের বংশীয় ঐতিহ্য ত্যাগ করে রিক্সা, ভ্যান চালানোসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে শ্রম বিক্রি করছিল। কিন্তু নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ায় জেগে ওঠে ছোট ছোট অসংখ্য বালুচর। এই চরে রবিফসল চাষ করা যায় নির্ভয়ে।
আর সেই চরেই শুরু হয়েছে জীবনের নতুন অধ্যায়। সত্তরের দশক থেকে এই চরে সবজি চাষে জীবিকা নির্বাহ করতেন কৃষক। কিন্তু অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ না পেলে খুব একটা লাভের মুখ দেখা যেত না। তবে যখন দেশের পোল্ট্রি ও ফিড মিল খাতে ভুট্টার চাহিদা বেড়ে যায় তখন চরাঞ্চলের কৃষকের চোখে জ্বলতে থাকে নতুন সম্ভাবনার আলো।
দিন যে এভাবে বদলে যাবে সুখের ঠিকানার দিকে সেটি এখন ভাবার বিষয়। এখন ফসলে ভরা চর। কৃষকরা দলবদ্ধভাবে ফসল কাটায় লিপ্ত। রোদের ঝিকিমিকিতে তিস্তা নদীর প্রান্তরে যেন মিটিমিটি হাসছে সোনালি ভুট্টার সারি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে একরাশ কাঁচাসোনা! চর থেকে কষ্ট করে গোটা ভুট্টা বয়ে আনতে হয় না ঘরে।
চরেই চলে আসে ভুট্টা ভাঙানো ডিজেলচালিত যন্ত্র। তাই চরের কৃষক চরেই ভুট্টা ভেঙে রোদে শুকিয়ে বস্তায় ভরে ঘরে তুলছে বা বিক্রি করে দিচ্ছেন। চাষিদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ভুট্টা বিক্রি করে আমাদের লাভ হয়। প্রায় অর্ধেক লাভ। আবার পাতা গরুকে খাওয়াতে পারি। মানে ভুট্টার আবাদ করলে বিভিন্নভাবে লাভ হয়।’ দেখা গেল কেউ গাছ কাটছেন, কেউ ভুট্টা ছাড়াচ্ছেন, আবার কেউ রোদে বিছিয়ে দিচ্ছেন শুকানোর জন্য।
মাঠজুড়ে শুধু কর্মচাঞ্চল্য আর আশাবাদের দৃশ্য। ভুট্টার ভালো ফলনে কৃষকের মুখে আনন্দের ঝিলিক- সব মিলিয়ে এক প্রশান্তিময় দৃশ্যপট। ভুট্টা এখন শুধু আর গবাদিপশুর খাদ্য নয়, মানুষের অন্যতম প্রয়োজনীয় দানা শস্য। উন্নত পুষ্টিমান ও বহুবিধ ব্যবহারের কারণে ভুট্টার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সঙ্গত কারণে ভুট্টার চাষ আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে।
অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে বেশি লাভ হওয়ায় রংপুর অঞ্চলে বেড়েছে ভুট্টা চাষ। ভুট্টা চাষি আমিনুল ইসলাম, জাহাঙ্গির আলম, রফিকুল ইসলাম, বাচ্ছু মিয়া, আব্দুল মতিন ও মিজানুর রহমানসহ অনেকে জানান, ভুট্টা চাষ করে তারা স্বাবলম্বী হয়েছে।
রংপুর কৃষি অঞ্চল অফিস সূত্রে জানানো হয়- এ বছর নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলায় ভুট্টা চাষ হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ২৫১ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর (২০২৪) ভুট্টা চাষ হয়েছিল এক লাখ ১৭ হাজার ৬১৯ হেক্টরে, ২০২৩ সালে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৮০ হেক্টর ও ২০২২ সালে চাষ হয়েছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে।
এর ১০ বছর আগে ভুট্টা চাষ ছিল মাত্র ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে। সে হিসাবে ভুট্টার চাষ বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি এই ৫ জেলায়। যা কল্পনা করা যায় না। উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ ভুট্টা চাষ হচ্ছে নদী তীরবর্তী গ্রাম ও চর এলাকায়। তবে এর পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে ভুট্টার চাষ বেড়েছে।
কৃষিবিদরা বলছেন, ভুট্টা একটি ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ যা থেকে খাদ্যশস্য হিসাবে ভুট্টার দানা সংগ্রহ করা হয়। ভুট্টার দানা থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। যেমন ভাত, রুটি, খিচুড়ি, মুড়ি, পপকর্ন, কর্নফ্লেক্স। এ ছাড়াও গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পানি জমে না এমন বন্যামুক্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়। সাধারণত পলিযুক্ত দোআঁশ, বেলে দোআঁশ এবং এঁটেল দোআঁশ মাটিতে ভুট্টা চাষ ভাল হয়।
বাংলাদেশের জলবায়ুতে সারা বছরই ভুট্টা চাষ করা সম্ভব। তবে ররি মৌসুমে ভুট্টা চাষ করলে আর্থিক ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় হাইব্রিড ও দেশী উভয় জাতীয় ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে। হাইব্রিড জাতে ফলন বেশি হওয়ায় দেশে আবাদকৃত মোট জমির ৯৫ ভাগেই হাইব্রিড জাতের চাষ হয়ে থাকে।
হাইব্রিড জাতের মধ্যে রয়েছে পেসিফিক-১১, পেসিফিক-৬০, পেসিফিক-৯৮৩, পেসিফিক-৯৮৪, পেসিফিক-৯৮৮, ৯০০ এম, মুক্তা, এনকে-৪৬, পায়োনিয়র ৩০৬৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩ উল্লেখযোগ্য। দেশী জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বর্ণালি, শুভ্রা, মোহর, খৈ ভুট্টা, বারি ভুট্টা-৫, বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭ ইত্যাদি। বীজ বপনের আগে বীজের গজানোর হার ৯০ ভাগের ওপর হলেই ওই বীজ কেনা উচিত। বীজ বপনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে বীজ গজানোর ক্ষমতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
সমতলে প্রতিএকরে গত বছর কৃষকরা একরে ৯০ থেকে ১১০ মণ ভুট্টা পেয়েছিলেন। তারা এ বছর পাচ্ছেন একরে ১৪০ মণ। গত বছরের চেয়ে দামও প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় তিস্তার বালুচরে ভুট্টায় বাজিমাত করছেন কৃষক।
প্রতিএকরে ভুট্টা উৎপাদনে খরচ হয় ৪৫ হাজার টাকা। তিস্তার চরের গড্ডিমারী এলাকার কৃষক নজর মাহদুম (৬৫) বলেন, সরকারি হিসাবে ৫০ শতকে এক বিঘা।
আমাদের এখানে ৩৩ শতকে এক বিঘা ধরা হয়। সে হিসাবে ‘এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। আশা করছি, ৮০০ মণ ভুট্টা পাব। গত বছর ১০ বিঘা জমিতে ৩৭২ মণ ভুট্টা পেয়েছিলাম। প্রতিমণ ১২ শ’ টাকায় বিক্রি করে পাই চার লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ টাকা। ভুট্টা উৎপাদনে খরচ হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।’ এ বছর তিনি প্রতিমণ ভুট্টা ১৩ শ’ থেকে ১৪ শ’ টাকায় বিক্রি করতে শুরু করেছেন। এ বছর ভুট্টা কেনার জন্য কয়েক ব্যবসায়ী তাকে অগ্রিম টাকা দিয়েছেন।
তিস্তার চরখড়িবাড়ি এলাকার কৃষক ইসমাইল হোসেন (৪৫) বলেন, ‘ভুট্টা বিক্রিতে সমস্যা হয় না। দামও সন্তোষজনক। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভুট্টার ফলন ভালো হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর দুই বিঘার বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। গত বছর ভুট্টা চাষ করেছিলাম সাত বিঘা জমিতে।’
তিস্তার চর শৌলমারী এলাকার কৃষক দিলবর হোসেন (৬০) বলেন, ‘ভুট্টা চাষ চরাঞ্চলে দারিদ্র্য কমিয়েছে। ভুট্টা চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছি। ভুট্টা ব্যবসায়ী ও ফিড কো¤পানির প্রতিনিধিরা সরাসরি আমাদের কাছ থেকে ভুট্টা কেনেন।’ এ বছর তিনি নয় বিঘা জমি থেকে ৩৪৫ মণ ভুট্টার ফলন আশা করছেন।
এলাকার ভুট্টা ব্যবসায়ী মোকসেদ আলী জানান, কয়েকটি ফিড কো¤পানি এ অঞ্চলে ক্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এসব কেন্দ্রে কৃষক সরাসরি ভুট্টা বিক্রি করেন। ‘আমরা কৃষকের কাছ থেকে ভুট্টা কিনে ফিড কো¤পানিগুলোয় সরবরাহ করি,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত বছর প্রতিমণ ভুট্টা এক হাজার ১৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায় কিনেছিলাম। এ বছর ভুট্টার দাম বেড়েছে অনেক।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক আফজাল হোসেন জানান, ‘ভুট্টা চাষে চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। রংপুর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ভুট্টা হয় তিস্তা নদীর তীরবর্তী গ্রাম ও চরাঞ্চলে। প্রকৃতপক্ষে তিস্তার চরাঞ্চলে ভুট্টা আজ অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে।